৩০ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১২:৫০

ধানের ক্ষতি কৃষিতে ধাক্কা

অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল

এবার এপ্রিলে দেশে ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে। মার্চের শেষের দিকে হয়েছে ভারি বর্ষণ। এ অতিবৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে পাহাড়ি ঢল ও জলাবদ্ধতা। এ কারণে সৃষ্ট বন্যায় হাওরাঞ্চলে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা গত ৪০ বছরেও হয়নি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান ও অন্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে কিংবা ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও কোথাও কোথাও ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে ধান। এতে কয়েক লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, চলতি বোরো মৌসুমে দেশের ৬৪ জেলায় মোট ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চাষাবাদ হয়েছে ৪৭ লাখ ৯৭ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে।
মার্চের শেষের দিক থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সুনামগঞ্জে। এ জেলার ছোট-বড় ১৩৩টি হাওরের সবগুলোর আধাপাকা ও কাঁচা বোরো ধান তলিয়ে গেছে। হাওর তলিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষকরা ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে; যদিও এ ধরনের অভিযোগ নাকচ করে দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকে।

হাওরাঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির একটি হালনাগাদ তথ্য দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। আজ রবিবার সুনামগঞ্জে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সামনে রেখে গত শুক্রবার আন্ত মন্ত্রণালয় বৈঠকে এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
এ তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার—এ ছয়টি জেলার ৬২টি উপজেলার ৫১৮টি ইউনিয়নের আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার মোট দুই লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ হাজার ৩৪৫টি ঘরবাড়ি আংশিক ও দুই হাজার ৮৬০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এ তালিকায় নেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যেখানে অকালবন্যায় প্রায় পাঁচ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ নিশ্চিত করেছে।

তবে হাওরে ১৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা নামের একটি সংগঠন। হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলার ৭৫ শতাংশ হাওরের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ বছর ২২ লাখ টন ধান হারিয়েছে কৃষক।
এ ছাড়া ময়মনসিংহ, জামালপুর ও শেরপুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ হেক্টর জমির বোরো ধান। গোপালগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাত হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান। চট্টগ্রামে এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমির ধান, লক্ষ্মীপুরে ৯২ হাজার ৩৩৬ হেক্টর জমির মধ্যে অর্ধেকেরই সয়াবিন, মরিচ, তরমুজ, ফেলন, মুগ, চিনাবাদাম ও মিষ্টি আলু নষ্ট হয়েছে। নোয়াখালীতে ক্ষতি হয়েছে তিন হাজারের বেশি হেক্টর জমির সয়াবিনসহ অন্য ফসল। চাঁদপুরে তলিয়ে গেছে তিন হাজার হেক্টর জমির ধান। কক্সবাজারে ১০ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সীতাকুণ্ডে ১১০ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। রাজবাড়ীতে দেড় হাজারের বেশি হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। ফেনীতে বিভিন্ন ফসল তলিয়ে ক্ষতি হয়েছে অন্তত তিন কোটি টাকার। পটুয়াখালীতে ২৬ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির মরিচ, তিল, বাদামসহ অন্য ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভোলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪ হাজার ১৮১ হেক্টর জমির রবিশস্য।

হাওরাঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গত শুক্রবার সর্বশেষ যে তথ্য দিয়েছে, সে অনুযায়ী সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার—এ ছয়টি জেলার ৬২টি উপজেলার ৫১৮টি ইউনিয়নের আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব এলাকার মোট দুই লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমি সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫ হাজার ৩৪৫টি ঘরবাড়ি আংশিক ও দুই হাজার ৮৬০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০টি উপজেলার ৪৬টি জলাশয়ের ২১৩.৯৫ মেট্রিক টন মাছ মারা গেছে। শুধু সুনামগঞ্জ জেলায় তিন হাজার ৯০২টি হাঁস ও চারটি মহিষ মারা গেছে।
সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা সুনামগঞ্জ। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জেলার ১৩৩টি ছোট-বড় হাওরের সব কটিই তলিয়ে যায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী জেলায় এক লাখ ৭২ হাজার ৬১৭টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে গত ২৫ এপ্রিল ঢাকায় পাঠানো এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সুনামগঞ্জের হাওরে ৯০ শতাংশ ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কারণ হিসেবে অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, আগাম বন্যা ও বাঁধ ভাঙার কথা বলা হয়েছে।
সূত্র মতে, এবার সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে দুই লাখ ২৩ হাজার ৮৮২ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে ইরিও রয়েছে। প্রায় এক লাখ ৪৯ হাজার ২২৪ হেক্টর বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকি জমির মধ্যে হাওরের বাইরে ইরি ও অন্যান্য স্থানে ১৭ হাজার ৩৮৮ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর। অতিবৃষ্টি ও ঢলে ১১৯ হেক্টর জমির সবজিও নষ্ট হয়েছে।

মত্স্য বিভাগের মতে, গত ১৬ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত হাওরে প্রায় ৫০ টন মাছ মারা গেছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এই পরিমাণ ২০০ টনেরও অধিক। এদিকে পুরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় ২০ লাখ গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে আছে চাষিরা। ধান তলিয়ে যাওয়ায় গোখাদ্য খড় এখন পানির নিচে। ফলে খাদ্যের অভাবে অল্প দামে গবাদি পশু বিক্রি করে দিচ্ছে কৃষক।
মৌলভীবাজার জেলার সাতটি উপজেলার ৬৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নের সংখ্যা ৬০। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২৪ হাজার ৮৭১ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৯ হাজার ৭২৩টি পরিবার। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ৮৯১টি ও আংশিক পাঁচ হাজার ৯১০টি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮ হাজার ৮৯৮ হেক্টর জমির বোরো ধান। মাছ মরেছে প্রায় ২৫ মেট্রিক টন। ৩৬৭টি হাঁস মারা গেছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, জেলার ১৩টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা দুই লাখ ১২ হাজার ৫৭০। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় আট লাখ ৫০ হাজার ২৮০ জন মানুষ।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র মতে, প্রায় সাড়ে ৬৪ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান ও সবজি তলিয়ে গেছে। মারা গেছে এক হাজার ৪৭৩টি হাঁস।

কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার ৫৬ ইউনিয়নের এক লাখ ৪৮ হাজার ৬৮৭টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৪৫ হাজার ২৫৬ হেক্টর। নেত্রকোনার ১০টি উপজেলার ৮৬টি ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা এক লাখ ৬৭ হাজার ১৮০। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১৯ হাজার ৫৬৬ হেক্টর। হবিগঞ্জের আটটি উপজেলার ৬৪টি ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৪ হাজার ৪৪০ পরিবার। ১৫ হাজার ৯৫৩ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
অন্য জেলায় ক্ষতি : ময়মনসিংহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, এ জেলায় দুই লাখ ৬৪ হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। তাঁদের তথ্য মতে, প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শেরপুর খামারবাড়ির উপপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন জানান, জেলার প্রায় চার হাজার ৯০০ হেক্টর জমির বোরো আবাদ অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে ঝিনাইগাতি উপজেলায়ই তলিয়ে গেছে সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমির ধান।
গোপালগঞ্জ কৃষি অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় সাত হাজার ৩৫০ হেক্টর বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ২৮০ হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এতে কমপক্ষে আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে ৩২৫ হেক্টর জমির তরমুজ আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১১২ হেক্টর জমির তরমুজ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য দুই কোটি ৮০ লাখ টাকা।

পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ বছর জেলায় ৮৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে মুগডাল আবাদ দেখিয়ে এর মধ্যে ২৬ হাজার ৭০০ হেক্টর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। মরিচ আবাদ আট হাজার ৯২২ হেক্টর এবং ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৯০০ হেক্টর; তিল আবাদ দুই হাজার ৮১২ হেক্টর, ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার হেক্টর, চিনা বাদাম পাঁচ হাজার ৬০৭ হেক্টর এবং ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৮০০ হেক্টর উল্লেখ করা হয়েছে।
ভোলার সাত উপজেলার বেশির ভাগ ফসলি জমির রবিশস্য তলিয়ে গেছে। এতে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, আগাম ও অতিবৃষ্টির কারণে গত কয়েক দিনে জেলায় ২৪ হাজার ১৮১ হেক্টর জমির রবিশস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অঙ্কে ১৬০ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। এ বছর জেলায় মোট এক লাখ ৪৪ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে রবিশস্যের আবাদ করা হয়েছে। ক্ষতির শিকার হয়েছে এক লাখ ৮১ হাজার ৩৫৮ জন কৃষক।
অতিবর্ষণ ও জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রামে প্রায় এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমির বোরো ধান ও গ্রীষ্মকালীন সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৫৫০ হেক্টর রোপা বোরো, ৫৪৫ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজি ও ২০০ হেক্টর জমি ফলনের ক্ষতি হয়েছে।

চাঁদপুর সদরের রাজরাজেশ্বর, ইব্রাহিমপুর, হাইমচরের গাজীপুর, নীলকমল ও হাইমচর ইউনিয়নের অন্তত ২৫টি চরের তিন হাজার হেক্টর নিচু জমির বোরো ধান ক্ষতির মুখে পড়েছে।
কক্সবাজারে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উপর্যুপরি অকাল ভারি বর্ষণ ও ব্লাস্ট রোগে জেলাব্যাপী এবারের বোরো আবাদে কমপক্ষে ১০ হাজার হেক্টর জমির ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আ ক ম শাহরিয়ার ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন। তিনি কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, ব্লাস্ট রোগে শুধু ব্রি-২৮ নম্বর ধানের কিছু ক্ষতি হলেও উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান বেশি উত্পাদন হয়েছে।
এদিকে রংপুর, খুলনা ও যশোরে চলতি বোরো মৌসুমে ব্রি-২৮, ব্রি-৬১ জাতের ধানে আবহাওয়াজনিত কারণে দেখা দিয়েছে ‘নেক ব্লাস্ট’ (গলা পচন) রোগ। ইতিমধ্যে রংপুর অঞ্চলে অনেক চাষীর ব্রি-২৮ জাতের ধানক্ষেত নষ্ট হয়েছে। রংপুরে ২৫, লালমনিরহাটে ১৮ ও নীলফামারীতে ২৫ হেক্টর জমির ফসল এ রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ক্ষতির হিসাবে গরমিল : অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলের সাত জেলায় এবার মোট তিন লাখ ৫৪ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমির বোরো ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সীমাহীন ক্ষতির শিকার হয়েছে আট লাখ ৩৬ হাজার ৫৩৩টি পরিবার। এ হিসাব কৃষি বিভাগের। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপন করা বক্তব্যে বলা হয়েছে, হাওরের ছয় জেলায় সম্পূর্ণভাবে ফসলের ক্ষতি হয়েছে মোট দুই লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির। যদিও এ হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা বলা হয়েছে আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮।

ওই সভায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে হাওরাঞ্চলের ছয় জেলা সুনামগঞ্জ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের নাম উল্লেখ করে জেলাওয়ারি ক্ষতির হিসাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নামই উল্লেখ করা হয়নি। অথচ এ জেলাতেও অকাল বন্যায় প্রায় পাঁচ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমির ফসলের সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ নিশ্চিত করেছে।
হাওর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে না নেওয়ার মানসিকতা থেকেই সত্য গোপনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির তালিকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে সুনামগঞ্জের পর দেখানো হয়েছে কিশোরগঞ্জকে। বলা হয়েছে, কিশোরগঞ্জে ৪৫ হাজার ২৫৬ হেক্টর জমির ফসলের সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়। গতকাল কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতি মিলিয়ে কিশোরগঞ্জে মোট ক্ষতি দেখানো হয়েছে ৬১ হাজার ২০৭ হেক্টর জমি। ’
খামারবাড়ী সূত্রমতে, কিশোরগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারের সংখ্যা এক লাখ ৫০ হাজার ৪৮১। অথচ ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ সংখ্যা এক লাখ ৪৮ হাজার ৬৮৭।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার হিসাবে সুনামগঞ্জের পরই নেত্রকোনার অবস্থান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, নেত্রকোনা জেলায় এবারের অকাল বন্যায় মোট প্রায় ৬৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক উপস্থাপন করা তথ্যে বলা হয়েছে, নেত্রকোনায় মাত্র ১৯ হাজার ৫৬৬ হেক্টর জমির ক্ষতি হয়েছে। জেলা খামারবাড়ীর উপপরিচালক বিলাস চন্দ্র পাল কালের কণ্ঠকে জানান, এ জেলায় এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা এক লাখ ১৭ হাজার। অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এ সংখ্যা এক লাখ ৬৭ হাজার ১৮০।
গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা খামারবাড়ী সূত্র জানায়, এবারের অকাল বন্যায় জেলার চার উপজেলায় বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত বোরো জমির পরিমাণ পাঁচ হাজার ৪৫০ হেক্টর। এর মধ্যে প্রত্যন্ত হাওরে অবস্থিত উপজেলা নাসিরনগরে তিন হাজার ৩১০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু নাছের কালের কণ্ঠকে বলেন, অকাল বন্যায় আক্রান্ত অনেক জমির ফসল কৃষকরা কেটে নিতে পেরেছে। তাই আংশিক ক্ষতি ধরা হয়নি।
হাওরে ১৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা নামের একটি সংগঠন। তাদের দাবি সাম্প্রতিক অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলার ৭৫ শতাংশ হাওরের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ পরিবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ বছর ২২ লাখ টন ধান হারিয়েছে কৃষক। মারা গেছে দুই হাজার টন মাছ। ৩০ হাজার হাঁসও মারা গেছে বলে দাবি সংগঠনটির। সংগঠনের তরফ থেকে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন করে এসব বিষয় জানানো হয়।

অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তালিকা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বাদ দেওয়ার ঘটনায় ঢাকার নাসিরনগর উপজেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলী আশরাফ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের। এমন হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সরকারের ত্রাণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। ’
হাওরের সাত জেলার সংগঠন ‘হাওর অঞ্চলবাসী’র অন্যতম সমন্বয়ক খন্দকার হাবিব রাজা বলেন, ‘দুর্যোগকে স্বীকার না করা এবং অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক কারণেই ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আড়াল করার মানসিকতা থেকেই সরকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম দেখাচ্ছে। কেননা প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ হলে সরকারকে এর পুরোপুরি দায় নিতে হবে। ’ তিনি হাওরের এ বিপর্যয়কে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণার দাবি জানান। ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জসহ অন্যান্য হাওর এলাকার মানুষও এ দাবি তুলেছে। তবে সরকার এ দাবি নাকচ করে দিয়েছে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা, খোলা বাজারে পণ্য বিক্রি ও পরিবার প্রতি ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা করে দেওয়ার একটি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/04/30/492437