৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ১০:৪৯

নির্দিষ্ট সময়ে দেশে আসেনি রপ্তানির ৪৪৫৭ কোটি টাকা

পণ্য জাহাজীকরণের চার মাসের মধ্যে রপ্তানির সম্পূর্ণ মূল্য দেশে আনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরের নির্ধারিত সময়ে দেশে আসেনি রপ্তানির ৫৩ কোটি ৩৮ লাখ ডলার; স্থানীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। আবার পণ্য আমদানির অর্থ পরিশোধের পরও নির্ধারিত সময়ে দেশে পণ্য না আসায় গত পৌনে দুই বছরে গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ আটটি শাখা অফিসের হিসাব সম্পর্কিত কমপ্লায়েন্স অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অধিদপ্তর তাদের প্রতিবেদনে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের আশঙ্কা করেছে।

আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এসব প্রতিষ্ঠান ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানে ৯৩৩ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করলেও দেশে এনেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। বাকি ৮২১ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ ২৫টি দেশে পাচার করতে ভুয়া রপ্তানি নথি ব্যবহার করেছে।

অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, তদারকি না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সহ চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অফিসের আওতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে মেয়াদোত্তীর্ণের দীর্ঘদিন পরও রপ্তানি মূল্য অপ্রত্যাবাসিত থাকায় দেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৩ কোটি ৩৮ লাখ ৬৪ হাজার ৭৮১ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের এক্সপোর্ট ও এনফোর্সমেন্ট শাখার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে মালপত্র রপ্তানি হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রধান কার্যালয়ের আওতাধীন ৪০টি তপশিলি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ৫১ কোটি ডলার বা ৪ হাজার ২৫৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা অপ্রত্যাবাসিত রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম অফিসের আওতাধীন বিভিন্ন তপশিলি ব্যাংকের মাধ্যমে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার এবং খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর অফিসের আওতায় ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে অপ্রত্যাবাসিত রয়েছে ৬১ লাখ ডলার। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর বলেছে, পণ্য জাহাজীকরণের চার মাস সময়সীমার মধ্যে রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসনে ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, বিষয়টি অনুসন্ধান বা তদন্তের জন্য বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে পাঠানোর কথা। অথচ তা পরিপালন করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ আসার নির্ধারিত মেয়াদের পর ১২ মাস অতিবাহিত হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি। এ বিষয়ে অডিট অধিদপ্তর ব্যাখ্যা চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি বিলের বিবরণী তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও জানায়, রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসন না হওয়ার বিবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– রপ্তানি পণ্যের শর্ট শিপমেন্ট হওয়া, রপ্তানিকারক বা বিদেশি ক্রেতার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, জাল-জালিয়াতি, ভুয়া রপ্তানি বা প্রতারণা এবং রপ্তানি মূল্য আদায়ের ক্ষেত্রে মামলা চলমান থাকা। মানি লন্ডারিং বা সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়নের উপাদান পাওয়া গেলে কেস টু কেস ভিত্তিতে অনুসন্ধানের জন্য বা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিএফআইইউতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণে রপ্তানি মূল্য অপ্রত্যাবাসিত থাকে। সব মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি বিল মানি লন্ডারিং বিবেচনার যৌক্তিক কারণ নেই।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেনি বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। তাদের যুক্তি, নির্ধারিত সময়ে রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসিত হয়নি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকিও করেনি। বিভিন্ন বছরে নিয়মিত শর্ট শিপমেন্ট হলেও এ বিষয়ে তদন্ত করা হয়নি। শর্ট শিপমেন্টজনিত পণ্য পরবর্তী সময়ে রপ্তানি হওয়ার বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জাল-জালিয়াতি, ভুয়া রপ্তানি, প্রতারণা ইত্যাদি বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা প্রমাণ সরবরাহ করা হয়নি।

আমদানি সংক্রান্ত অনিয়ম
নিরীক্ষাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন ডিপার্টমেন্টের ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মোট এক বছর ৯ মাসের আমদানি নথি, সরবরাহ করা অসমন্বিত বিল অব এন্ট্রির বিবরণী পর্যালোচনা করা হয়। এ সময় বিভিন্ন তপশিলি ব্যাংকের গ্রাহকের নামে আমদানি করা মালপত্রের মেয়াদোত্তীর্ণ বিল অব এন্ট্রির বিপরীতে ৫১১ কোটি ১১ লাখ ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৪২ হাজার ৬০২ কোটি ১৯ লাখ টাকা অনাদায়ী ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নীতিমালা অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়ের চার মাসের মধ্যে দেশে আমদানি হওয়ার সপক্ষে বিল অব এন্ট্রি জমায় ব্যর্থ আমদানিকারক তথা প্রতিষ্ঠানের জন্য এলসি খোলা, বন্ধ রাখাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিল অব এন্ট্রিগুলো ওভারডিউ থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি। ডলার ছাড়ের চার মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পণ্য না আসায় বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে অডিট অধিদপ্তর ব্যাখ্যা চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, আমদানির পক্ষে কাস্টম কর্তৃপক্ষ বিল অব এন্ট্রি ইস্যু করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মেয়াদোত্তীর্ণ বিল অব এন্ট্রির বিবরণী তৈরি করে সমন্বয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠায়। বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করলে আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানায়, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ২০২১ সালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এডি শাখা ও গ্রাহককে বিল অব এন্ট্রি সমন্বয়ে বাড়তি সময় দেওয়া হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে অডিট অধিদপ্তর বলেছে, নীতিমালা অনুযায়ী বিল অব এন্ট্রি অসমন্বিত থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ব্যতীত ওই আমদানিকারকের অনুকূলে নতুন ঋণপত্র খোলা যাবে না। তারপরও ক্রমাগত এলসি খোলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথাযথ তদারকি না থাকায় এ ধরনের আর্থিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। দায়-দায়িত্ব নির্ধারণপূর্বক অসমন্বিত বিল অব এন্ট্রিগুলো অতিসত্বর সমন্বয় করে অডিট অধিদপ্তরকে জানাতে বলা হয়েছে।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত অসমন্বিত বিল নিষ্পত্তি চলমান প্রক্রিয়া। নিরীক্ষার সময় যে চিত্র উঠে এসেছে, এখন তা অনেকাংশে কমে এসেছে। ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিটি কেস আলাদা না দেখে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে সাধারণভাবে বাণিজ্যের কিছু অংশ অসমন্বিত থাকে।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমদানি-রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচারের কথা সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিজেই স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে বলেও জানানো হয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আগে থেকে যদি এসব জায়গায় ভালো তদারকি থাকত, তাহলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ত। বর্তমানে ডলারের যে তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে, তা এড়ানো যেত।’

https://samakal.com/bangladesh/article/2309194323