৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ১০:২৯

অপুষ্টিতে ভুগছে গরিবের পুষ্টিচাল কর্মসূচি

খাদ্য অধিদফতরের অনাগ্রহ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা

খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতা ও কারো কারো ব্যক্তি সুবিধা-অসুবিধায় মাঠে মারা যাচ্ছে সরকারের পুষ্টিচাল বিতরণ কর্মসূচি। দেশের হতদরিদ্র শ্রেণীর মানুষের পুষ্টিহীনতা দূর করার জন্য ২০২১ সালে বড় পরিসরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ২৫১ উপজেলায় পুষ্টিচাল বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। ছয়টি ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ এই চাল দরিদ্রদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম খাদ্যবান্ধব ও ভিডব্লিডবি (ভালনেরেবল ওমেন বেনিফিসিয়ারি) কর্মসূচিতে বিতরণ করার কথা। কিন্তু শুরু থেকেই এটি হোঁচট খেয়ে আসছে। গরিবের পুষ্টিচাল কর্মসূচি যেন অপুষ্টিতে ধরেছে।

জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব নিজেই অবগত নন : মানুষের দেহে ভিটামিন এ, বি১, বি১২, ফলিক এসিড, আয়রন ও জিংক- এই ছয়টি অনুপুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে নারী ও শিশু-কিশোরদের ভেতর এই সমস্য বেশি। বাংলাদেশের মানুষের ভাত যেহেতু প্রধান খাদ্য তাই চালকে পুষ্টি সমৃদ্ধ করে দেশের হতদরিদ্র মানুষের পুষ্টি ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০২১ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘পুষ্টি উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক নির্দেশিকা জারি করা হয়। আগে থেকেই চালু থাকা সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় পর্যায়ক্রমে ১৫০টি উপজেলায় বিনামূল্যে পুষ্টিচাল বিতরণ হয়ে আসছিল। ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আরো ১০১টি উপজেলা যুক্ত করে মোট ২৫১টি উপজেলায় পুষ্টিচাল বিতরণ কার্যক্রম হাতে নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে পুষ্টিচালবিষয়ক জাতীয় কমিটির সভাপতি স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (সংগ্রহ ও সরবরাহ) করা হয় সদস্যসচিব।

অতিরিক্ত সচিব (সংগ্রহ ও সরবরাহ) পদে থাকা মো: মমতাজ উদ্দিনের সাথে গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে সরাসরি কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এই ধরনের কমিটির কথা তিনি জানেনই না। পরে তিনি তার পিয়নকে মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ শাখা থেকে ‘পুষ্টিচাল উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক নির্দেশিকা, ২০১৩’ আনার জন্য নির্দেশ দেন। পুষ্টিচাল বিষয়ে বিস্তারিত জানতে সচিব মো: ইসমাইল হোসেনের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সচিবের দফতরে গেলে তিনি জরুরি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। এর দু’দিন আগে খাদ্যসচিবকে পুষ্টিচাল বিতরণ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কী কী জানতে চান, অফিসে এসে বলুন।’

যেভাবে তৈরি হয় পুষ্টিচাল : সাধারণ চালের সাথে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি১, ভিটামিন-বি১২, ভিটামিন-বি৯ (ফলিক এসিড), আয়রন ও জিঙ্ক উপাদান সমৃদ্ধ দানাদার চাল বা কার্নেল উৎপাদন করা হয়। পরে সাধারণ চালের সাথে ১০০:১ অনুপাতে কার্নেল মিশিয়ে পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল (ফর্টিফায়েড রাইস) প্রস্তুত করা হয়। প্রতি ১০০টি সাধারণ চালের সাথে একটি পুষ্টিচাল অর্থাৎ ১০০ কেজিতে এক কেজি হারে পুষ্টিচাল মেশানো হয়। এ মিশ্রণ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হয়ে থাকে। এ চালের মাধ্যমে পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়, কিন্তু চালের স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয় না।

কী হচ্ছে পুষ্টি চাল নিয়ে : আগে ছয়টি ভিটামিন সমৃদ্ধ দানা বিদেশ হতে আমদনি করা হতো উচ্চমূল্যে। পুষ্টিচাল বিতরণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও সরবরাহের জন্য সরকার মিশ্রণ মিলার নিযুক্ত করেছে। সরকারকে স্বল্পমূল্যে ভিটামিন দানা সরবরাহ করার জন্য খাদ্য অধিদফতরের আহ্বানে ১০টি কারখানা স্থাপন করেছে। এ ছাড়া সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও খাদ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবহেলা-অনাগ্রহের কারণে আলোর মুখ দেখেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাইভেট খাতে ১০টি মিশ্রণ মিলার কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে কারখানা স্থাপন করলেও কার্নেল সরবরাহ না থাকায় বেকার বসে আছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর মার্চ ও এপ্রিল এবং সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর- এই পাঁচ মাসে ২৫১টি উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় নামমাত্র মূল্যে পুষ্টিচাল বিতরণ করার কথা। চলতি বছর শুধু মার্চ মাসে পুষ্টিচাল বিতরণ হয়েছে। চলতি সেপ্টেম্বর এবং আগামী অক্টোবর মাসের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় গত আগস্ট মাসেই আগাম সাধারণ চাল বিতরণ সম্পন্ন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে পুষ্টিচাল বিতরণ হচ্ছে না-এটা নিশ্চিত। আগামী নভেম্বর মাসে পুষ্টিচাল বিতরণের জন্য গত পরশু টেন্ডার আহ্বান করেছে খাদ্য অধিদফতর। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নভেম্বর মাসেও পুষ্টিচাল বিতরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এর আগে ২০২২ সালেও শুধু দুই মাস (এপ্রিল ও নভেম্বর) পুষ্টিচাল বিতরণ করা হয়েছিল।

অন্য দিকে ভিডব্লিউবি (ভালনেরবল ওমেন বেনিফিসিয়ারি) কর্মসূচির আওতায় ১৭০ উপজেলায় ১২ মাস পুষ্টিচাল বিতরণ করা কথা। সেক্ষেত্রে গত জুলাই আগস্টে পুষ্টিচাল বিতরণ হয়নি। আগামী অক্টোবর মাসেও বিতরণ অনিশ্চিত। গত বছর জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসে পুষ্টিচাল বিতরণ হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১ জুন ১০০টি উপজেলা খাদ্যবান্ধব কমসূচির দরপত্র আহ্বান করা হয়। পরে ওই বছরের ২৮ মার্চের মধ্যে মিশ্রণ মিলাররা চুক্তি সম্পাদন করে। কিন্তু খাদ্য অধিদফতরের শীর্ষ দুই কর্মকর্তার অনিচ্ছায় পাঁচ মাসের মধ্যে তিন মাসের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে পুষ্টিচাল সরবরাহ হয়নি। একইভাবে গত বছরের (২০২২) ১২ মে ১৫৫টি উপজেলায় ভিডব্লিউবি কর্মসূচির দরপত্র আহ্বান করা হয়। পরে ১৭ নভেম্বর মিশ্রণ মিলারদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করা হয়। একইভাবে খাদ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্তাদের অনাগ্রহের কারণে ১২ মাসের মধ্যে তিন মাসে পুষ্টিচাল বিতরণ সম্ভব হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর (স্মারক নং ৩৫৩), এবং চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কাজ সম্পাদন করার জন্য ৬৪০ মে. টন কার্নেল ক্রয়ের অনুমোদন দেয়া হয়। বাস্তবে মাত্র এক মাসের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

গত ১৫ মে ৩ হাজার ৩০ মেট্রিক টন কার্নেল ক্রয়ের অনুমোদন দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। যাতে সময় মতো কার্নেল ক্রয় করে চলতি সেপ্টেম্বর ও আগামী অক্টোবর মাসের পুষ্টিচাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত না হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় বারবার তাগিদ দেয় যাতে অন্তত দুই মাস আগে কার্নেল ক্রয়ের টেন্ডার দেয়া হয়। কিন্তু গড়িমসি করে কাটছাঁট করে গত ৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ১ হাজার ৭২৫ মেট্রিক টন কার্নেল ক্রয়ের টেন্ডার আহবান করে খাদ্য অধিদফতর।

এভাবে খাদ্য অধিদফতর থেকে কার্নেল ক্রয়ে টেন্ডার আহ্বানে গড়িমসিসহ নানাভাবে পুষ্টিচাল কর্মসূচি ব্যাহত করছে। এতে অধিদফতরের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর থাকলেও ব্যবসায়ীদের কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে খাদ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বারবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি। গতকাল খাদ্য অধিদফতরে গিয়ে জানা যায় তিনি মিটিংয়ে আছেন। একইভাবে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো: শাখাওয়াত হোসেনও মিটিংয়ে ছিলেন। তবে গত পরশু ডিজিকে ফোন দেয়া হলে প্রথমেই বলেন, লিফটে আছি। যেকোনো মুহূর্তে কেটে যেতে পারে। তিনি বলেন, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে চাল দেয়া হয়। বিশ^ ব্যবস্থার আলোকে খাদ্য গুদামে খাবার (চাল) বেশি রাখতে হবে, এমন নির্দেশনার আলোকে ওই দুই মাসের চাল (পুষ্টি মিশ্রণ ছাড়াই) গত আগস্ট মাসে আগাম বিতরণ করা হয়েছে। ইন্ডিয়া খাদ্য রফতানি বন্ধ করেছে। গোডাউন খালি করা হয়েছে, যাতে পর্যাপ্ত চাল কিনে রাখা যায়। বাকি যে থাকল নভেম্বর মাস, সেটা কার্নেল কিনে সরবরাহ করতে হবে। তিনি বলেন, ২৫১টি উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি চলমান। তবে, পুষ্টিচাল বিতরণ প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে যান।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/775198