৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:২৪

নাব্য সংকটে ডুবোচর ভ্রমণ আতঙ্কে পর্যটকরা

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা: আন্তঃদেশীয় নদীতে উজানে বাঁধ নির্মাণের ফলে পানিপ্রবাহ কমে পলি জমে ও ভরাট হয়ে সুন্দরবনের বেশকিছু খাল ভরাট হয়ে গেছে। নৈসর্গিক জীবন্তসত্তা নদী-খাল জালের মতো জড়িয়ে থাকা বনের ভেতর ছোট বড় ৪৫০টি নদী-খাল পলিপড়ে অস্তিত্ব হারাচ্ছে। বনের নদী-খালে পানির প্রবাহ ক্রমশ কমে গেছে। সত্তরের দশকে ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে উজান থেকে অভিন্ন নদ-নদীর পানি না দেওয়ায় সুন্দরবনে মিঠাপানির প্রবাহ কমে আসে, এতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ায় অধিকাংশ নদ-নদী জৌলুস হারিয়েছে। এতে করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জনসংখ্যার চাপ ও সুশাসনের অভাব নদ-নদী ও পরিবেশ রক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। তারা বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নদীসহ পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ফলে নদী ব্যবস্থাপনায় বড়ধরনের পরিবর্তন এসেছে। যা দীর্ঘস্থায়ী সংকট তৈরি করছে। উপকূলে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

জোয়ারভাটায় ঢেউ খেলানো অসংখ্য নদীর মোহনা অবস্থিত সুন্দরবনের ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে জলাকীর্ণ অঞ্চল। যা পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন, অর্থনীতি ও পর্যটন প্রভৃতির অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কিত। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন, যা দেশের মোট আয়তনের ৪ শতাংশ এবং মোট বনভূমি ৪০ শতাংশ। সুন্দরবনের প্রতিরোধ ও উৎপাদনমূলক ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি সমৃদ্ধি ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা পাচ্ছে। বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশের ঐশ্বর্য, মর্যাদা ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে সুন্দরবনের বড় ভূমিকা রয়েছে। অনন্য গুরুত্ব বিবেচনায় ‘কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস’ ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার জলাভূমি অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমিগুলোকে রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অসামান্য মূল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো এই বনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে।

সূত্রমতে, সুন্দরবন অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নদ-নদীগুলো হচ্ছে- বলেশ্বর, পশুর, শিবসা, খোলপেটুয়া, কালিন্দি, মজ্জত, সুমতি, ছাপড়াখালি, বড়শেওলা, হারণচীনা, শাকবাড়ে সিঙ্গা, হংসবাগ, দোবেকি, ধানিবুনে, হরিখালি, পাট কোস্টা, বাসে, লাঠিকারা, ব্যয়না, কাসিটানা, দায়াহলড়ি, আড়ভাঙ্গা, ইলিশমারী, জলকি, বিবির মাদে, টেমখানি, চামটা, মধুখালি, পরশকাঠি, ধনপতি, রাগাখালি, কানাইকাঠি, মরিচঝাপি, নেতাই, শাকভাতে, চুনকুড়ি, মারাদি, যুগলবাড়ি, বাদামতলী, ঘাট হারানো, বড়বাড়ে, মুকুলে, বড় মাতলা, তুকুনী, কাঁচি কাটা, পারশেমারী ইত্যাদি। এসব নদীগুলোতে বর্ষাকালে পর্যাপ্ত নাব্যতা থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় এর পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পায়। আবার অনেক নদ-নদীতে ডুবোচর তৈরি হওয়ায় পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণে আতঙ্কে থাকেন। নদ-নদী বেষ্টিত দ্বীপভূমি সুন্দরবনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা পর্যটকরা যেমন ভোগান্তিতে পড়েন তেমনি মোংলা বন্দরে আসা ছোট-বড় জাহাজ কার্গোও মাঝেমধ্যে সমস্যায় পড়ে ডুবোচরের কারণে।

এদিকে সুন্দরবনের প্রাণ পশুর নদীসহ সুন্দরবন অঞ্চলের নদ-নদী ও খালের জীবন্ত সত্তা ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে উপকূলবাসী। স্থানীয় মৎস্যজীবী, বনজীবী, জেলে, বাওয়ালী-মাওয়ালীদের সাথে কথা হয়। তারা জানান, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন,পরিবেশ-প্রকৃতি বিরোধী উন্নয়ন কর্মকান্ড, দখল এবং দূষণে বিপর্যস্ত সুন্দরবন অঞ্চলের নদ-নদী ও খালের গতি প্রবাহ সচল রেখে পরিবেশ ও জনবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তারা বলেন, নদীতে আনফিট নৌযান চলাচলের ফলে প্রতিনিয়ত তেল-কয়লা ভর্তি জাহাজ ডুবির ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হুমকিতে পড়েছে। দূষণের কারণে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে নদী পাড়ের মানুষ। পাশাপাশি অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে হুমকির মুখে নদ-নদী ও জীববৈচিত্র্য। ধবংস হচ্ছে বনভূমি। বিশেষ করে সুন্দরবন ধ্বংসের কারণে হুমকির মুখে সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল। এ অবস্থায় উপকূলের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান সংশ্লিষ্টদের।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন হিরণ পয়েন্ট থেকে সুন্দরী কোঠায় নদ-নদীতে পলির প্রভাবে নাব্য সঙ্কট দেখা দেওয়ায় আউটারবার প্রকল্পের আওতায় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন করে ইতোমধ্যে চ্যানেলের নাব্যতা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে মোংলা বন্দরে অধিক ড্রাফটের বাণিজ্যিক জাহাজ আগমন শুরু হয়েছে। এছাড়া ইনারবার প্রকল্পের আওতায় হাড়বাড়িয়া থেকে মোংলা বন্দর জেটি পর্যন্ত ১০ মিটার ড্রাফটের বাণিজ্যিক জাহাজ আগমনের লক্ষ্য নিয়ে ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে যা সম্পন্ন হলে মোংলা বন্দর জেটিতে নিরাপদে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে।

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করীম বলেন, পলি ও বালি জমে সুন্দরবন অঞ্চলের বেশ কিছু নদ-নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ডুবো চর। নাব্য সংকটের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সুন্দরবনের নদ-নদীতে বঙ্গোপসাগর থেকে জোয়ারে প্রচন্ড পলি ও বালি আসে। যে কারণে ডুবোচর তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে গবেষণা চালিয়ে বের করতে হবে কিভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।

সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আওতাধীন এলাকায় ২০টির ওপর খাল পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া জয়মনি থেকে দাসের ভারানী পর্যন্ত ভোলা নদী, খড়মা খাল ও আড়–য়ারবেড় খালের ৩০ কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। সুন্দরবনের মধ্যে লবণাক্ততাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/534602