৩০ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১২:১৯

ট্যানারি শিল্প বন্ধ থাকায় চামড়া খাচ্ছে কুকুর!

আন্দোলন আর সংগ্রামের মধ্যেও থেমে নেই গরুর ট্রাকে চাঁদাবাজি। সীমান্তে চাঁদা না দিলেই চলে বিএসএফের গুলী। গাবতলী গরুর হাটেও চলছে হাসলি আদায়ের নামে বেপরোয়া হয়রানি। ট্যানারি শিল্প বন্ধ থাকায় চামড়া খাচ্ছে (ডলার) কুকুরে। গত ২৩ দিনেই গোশত ব্যবসায়ীদের শুধু চামড়ায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা। তাছাড়া দাম বেশি হওয়ার কারণে গরুর গোশত কিনছেন না সাধারণ গ্রাহকরা। এতে করে সারা দেশে গোশতের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সরকার তাদের দাবি আদায় না করে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এসব অনিয়ম বন্ধে আবার ধর্মঘটে যাচ্ছেন গোশত ব্যবসায়ীরা।

চলছে গত ১৩ এপ্রিল স্থানীয় সরকার ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে দ্বিতীয় দফায় দাবি আদায়ে সতর্কবার্তা দেন মাংস ব্যবসায়ীরা। ওই সময় ৩০ এপ্রিলের (আজকের) মধ্যে সব দাবি পূরণ না হলে আবারও আন্দোলনে নামার কথা জানানো হয়। সেই আন্দোলন রমযানে প্রথম দিন থেকে শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।
মাংস ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন, আজ ৩০ এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনে নতুন করে ১৫ দিনের আলটিমেটাম দেয়া হবে। এরপর দাবি পূরণ না হলে রমযানের প্রথম দিন থেকে সারা দেশে গোশত বিক্রি বন্ধ রাখা হবে।
সূত্র জানায়, সারাদেশে প্রায় ১ লাখ গোশতের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে প্রতিদিন গড়ে দুটি করে গরু যবাই করা হয়ে থাকে। এর বাইরেও রয়েছে নানা ধরনের অনুষ্ঠান। এ হিসেবে প্রতিদিন দেশে গরুর চাহিদা রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ। সে হিসেবে সারা দেশে ২৩ দিনে প্রায় ৬০ লাখ গরু যবাই করা হয়েছে। এসব গরুর চামড়া অবিক্রিত রয়েছে। দাম বেশি হওয়ার কারণে গোশতের বিক্রি কমেছে প্রায় ৫০ ভাগ। এতে করে কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ একটি লবণযুক্ত চামড়া বিক্রি হয়ে থাকে গড়ে তিন হাজার টাকা করে। এর সাথে রয়েছে মাথার চামড়া, সিং, পেনিস, অন্ডকোষ, গোল্লা, লেজ, খুড়া, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি হয়ে থাকে আরো হাজার টাকা। গোশত বিক্রিতে লাভ না হলেও এসব বিক্রি করেই তারা ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু হাজারিবাগে ট্যানারি বন্ধ থাকার কারণে চামড়াসহ গরুর এসব অঙ্গ প্রতঙ্গ বিক্রি বন্ধ রয়েছে। এতে করে গত ২৩ দিনেই তাদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা।
সূত্র আরও জানায়, ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে একটি গরু আনতে বিএসএফকে ঘুষ দিতে হচ্ছে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও প্রতিটি গরুর ট্রাকে দিতে হচ্ছে নানা রকমের চাঁদা। সীমান্তে টাকা না দিলেই চালানো হয় গুলী। এরপর শুরু হয় গাবতলী হাটের ইজারাদার মজিবর বাহিনীর হাসলি আদায়ের নামে নানা ধরনের নির্যাতন। এসব অনিয়মের প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা দুই সিটি কর্পোরেশনে এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ে অভিযোগ দিলেও কোনো কাজে আসেনি।
এমকি এসব দাবিতে ধর্মঘট করলেও বহাল তবিয়তে রয়েছে মজিবুর বাহিনী। উল্টো তারা চাঁদাবাজি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে করে গোশতের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। গোশত বিক্রি কমে গেছে ৫০ ভাগ। দোকান বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধেক। ট্যানারি বন্ধ হওয়াতে লোকসানের মুখে পড়েছে গোশত ব্যবসায়ীরা।
এরই মধ্যে সারা দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করেছেন। দাবি পূরণ না হলে সারা দেশে একযোগে কর্মবিরতির বিষয়ে ব্যবসায়ীরা একমত হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। রমযানের আগেই তাদের সব দাবি পূরণ করে গোশতের দাম কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই বলেছেন তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রকে চিঠি দিয়েছি। যদিও গতবার একইভাবে তাদের অবগত করে ধর্মঘটে গেলেও তারা দাবি মানেননি। উল্টো আমাদের খাজনা দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতে গোশতের দাম বাড়াতে হলো। এবার দাবি পূরণ না হলে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট করব আমরা।

তিনি আরও বলেন, গোশত দেশে পাঁচ শ’ টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এখনও মুরগির গোশতের দাম ১৬০ টাকা। তাহলে মানুষ কেন গরুর গোশত হবে। চাঁদাবাজি আর হয়রানির কারণে গোশতের দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এবার গরুর হাটগুলোয় ইজারাদারদের যেসব শর্ত মেনে হাট পরিচালনার কথা তার বাস্তবায়ন, গোশতের দাম মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে যেসব ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন সেগুলোর বাস্তবায়ন, নির্দিষ্ট স্থানে জবাইখানা নির্মাণ এবং ট্যানারি স্থানান্তরে সরকারের সুষ্ঠু সহযোগিতার মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়েছি আমরা। এসব সমাধান না হলে আমরা ব্যবসা করতে পারব না।

রবিউল আলম বলেন, যদি কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে আলোচনায় না বসে তাহলে আজ ৩০ এপ্রিল আবার আন্দোলনের ঘোষণা দেব। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সাংবাদিক সম্মেলন করব। নতুন করে ১৫ দিন সময় দেব। তারপর দাবি পূরণ না হলে রমযানে গোশত বিক্রি বন্ধ থাকবে। এ সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ডলার এখন কুকুরে খাচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের চামড়া বিক্রি হয়ে থাকে ডলারে। আর সে চামড়া এখন কুকুরে খাচ্ছে। হাজারিবাগে ট্যানারি বন্ধ থাকার কারণে চামড়া এখনও মাটির নিচে পুতে রাখতে হচ্ছে। আর মাটির নিচ থেকে তুলে তা কুকুরে খাচ্ছে। এ অবস্থা চলছে গত ২৩ দিন যাবত। আর কত দিন চলবে জানিনা। তবে এভাবে আর ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সরকার দাবি না মানলে আমরা ব্যবসা বন্ধ করে অন্য ব্যবসা করতে বাধ্য হবো।
এদিকে এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে বেশ কিছু দাবিতে মাংস ব্যবসায়ীরা রাজধানীতে ছয় দিনের কর্মবিরতি পালন করেন। তখন তারা গোশত বিক্রি বন্ধ রাখেন। পরে দাবি-দাওয়া পূরণ হয়নি বলে জানিয়েছেন মাংস ব্যবসায়ীরা। এতে গোশত বিক্রি শুরু করলেও তখন গোশতের দাম কেজিতে প্রায় ১০০ টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়।
গোশত ব্যবসায়ীরা জানান, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর-সংক্রান্ত জটিলতায় তাদের চামড়া বিক্রি হচ্ছে না। গরুর হাটে নানা ধরনের অনিয়ম বন্ধ না হওয়ায় কম দামে গোশত বিক্রি করা যাচ্ছে না। ক্রেতারাও বেশি দামে গোশত কেনা কমিয়ে দিয়েছে। দেশে প্রায় অর্ধেক গোশতের দোকান গুটিয়ে গেছে। এছাড়া নির্দিষ্ট ও পর্যাপ্ত জবাইখানা স্থাপন, গাবতলী পর্যন্ত গরু আনতে চাঁদাবাজি বন্ধ, অতিরিক্ত খাজনা আদায় বন্ধসহ কয়েকটি দাবি রয়েছে গোশত ব্যবসায়ীদের।
এসব দাবিতে সরকার কেন নীরব তা আমরা বুঝতে পারছি না। তবে এবার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। কারণ এটি আমাদের রুটি রুযির প্রশ্ন। চাঁদাবাজি বন্ধ করতেই হবে। জনগণকে যেকোনো মূল্যে ৩০০ টাকায় গরুর গোশত খাওয়াতে চাই। এজন্য সবার সহায়তা প্রয়োজন।

http://www.dailysangram.com/post/281936