২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৮:০৩

প্রশিক্ষণে ব্যয় ৬১ কোটি ভ্রমণে ৩১ কোটি টাকা

প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১ কোটি টাকা, ভ্রমণে ৩১ কোটি টাকা। জনপ্রতি আপ্যায়ন ব্যয় বরাদ্দ ৯৫০ টাকা। মনিহারিসামগ্রী কেনায় ব্যয় সোয়া ৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অর্থনৈতিক শুমারি প্রকল্পের কিছু খাতে এমন অস্বাভাবিক ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ জন্য প্রকল্পটি আবার যাচাই-বাছাই করা হবে। আগামীকাল রবিবার পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন বলে জানা গেছে।

বিবিএসের অধীন ‘অর্থনৈতিক শুমারি ২০২৩’ প্রকল্পটি গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদিত হয়। সভা শেষে ওই দিন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিতে পারেননি।
৫৭৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকার এই প্রকল্পে এত টাকা কোথায় কিভাবে ব্যয় করা হবে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপিতে) এর কোনো সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই।

এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ের লাগাম টানতে সরকারের প্রজ্ঞাপন, সার্কুলার, নির্দেশনা কোনোটাই কাজে আসছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক সভায় বারবার বলছেন অপচয়-অপব্যয় কমাতে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তা প্রতিপালন হচ্ছে না। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও প্রকল্প প্রস্তাবে আসছে বারবার বিদেশভ্রমণের বিষয়।

অর্থনৈতিক শুমারির প্রকল্প প্রস্তাবে একটি সার্ভার সিস্টেমের ব্যয় বরাদ্দ হয়েছে ১২ কোটি টাকা। ৪০টি কম্পিউটারের দাম ধরা হয়েছে ৪৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ১০৭টি সেমিনারে ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি সেমিনারে খরচ দেড় লাখ টাকার বেশি।

প্রকল্প প্রস্তাব থেকে জানা গেছে, দেশে বিদ্যমান সব ব্যবসা, শিল্প, সেবা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেইস প্রণয়ন করার মাধ্যমে সময়ের বিবর্তনে অর্থনীতিতে যে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে, তার স্বরূপ নির্ধারণ করা হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে।

এ ছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ স্ট্যাটিসটিক্যাল বিজনেস রেজিস্টার প্রণয়ন করতে চাইছে বিবিএস।
২০২২ সালে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় প্রথমে ধরা হয় ৭৮৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুন প্রর্যন্ত। প্রাথমিক প্রস্তাবের পর পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের পিইসি সভায় বেশ কিছু খরচের ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়। ওই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে মোট ৬৮৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে আবার সংশোধিত আকারে প্রস্তাব করে বিবিএস। এখন প্রকল্পটির মেয়াদ কমিয়ে আড়াই বছরে বাস্তবায়নের জন্য ৫৭৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ করার কথা।

প্রকল্পের খরচের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, তখন পুনর্গঠিত ডিপিপিতেও কিছু অসামঞ্জস্য পায় পরিকল্পনা কমিশন। ২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় প্রস্তাবিত ডিপিপির চেয়ে বর্তমানে প্রস্তাবিত ডিপিপির মোট ব্যয় ৫১ কোটি ৬২ লাখ টাকা কমানো হলেও আবার কিছু ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া কিছু অঙ্গ নতুন করে যোগ করা হয়েছে। একাধিক খাতে, বিশেষ করে ইন্টারনেট বা ফ্যাক্স বা টেলেক্স, প্রশিক্ষণ, ভ্রমণ ব্যয়, জরিপ, স্টেশনারি, কম্পিউটার সরঞ্জামাদি, আসবাবসহ বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় কমানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে আগের পিইসিতে বলা হয়।

ব্যয় বরাদ্দের তথ্য বলছে, প্রশিক্ষণে বরাদ্দ রয়েছে ৬১ কোটি ২০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ৩০ মাসে চুক্তিতে যানবাহনের জন্য রয়েছে চার কোটি ১৩ লাখ টাকা। পরামর্শক ব্যয় চারজনে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। ইন্টারনেট, ফ্যাক্সে প্রায় সাত কোটি টাকা। আবার পরিবহন খাতে ব্যয় এক কোটি ৬৮ লাখ ৭০ হাজর টাকা। যানবাহন ছাড়াও অভ্যন্তরীণ ভ্রমণে ব্যয় ৩১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। একনেক সভা পরবর্তী ব্রিফিংয়ে তথ্য ও পরিসংখ্যান সচিব শাহনাজ আরেফিনের কাছে কম্পিউটারের বিপুল অঙ্কের মূল্য ধরা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। এটার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এই মুহূর্তে তা সম্ভব নয়।’
প্রশ্ন রাখা হয়, জনশুমারির ট্যাব দিয়ে অর্থনৈতিক শুমারির কাজ করা হবে। কিন্তু এখন নতুন করে কেন কম্পিউটার কেনা হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে বিবিএস সচিব বলেন, ‘জনশুমারির প্রকল্পের কাজ এখনো চলমান। আর দুটি প্রকল্প এক নয়। একটি প্রকল্পের সঙ্গে আরেকটি মেলালে চলবে না।’

এ সময় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ওই প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বসা হবে বলে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেন।

প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য আবদুল বাকী ব্রিফিংয়ে বলেন, এই প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে দুইবার পিইসি সভা করেছেন। ফলে মূল প্রস্তাব থেকে ১৫০ কোটি টাকা কমানো সম্ভব হয়েছে। এই প্রকল্পে যন্ত্রপাতির সংখ্যাই বেশি। তিনি বিষয়টি আবার খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এই প্রকল্পে বেশ কিছু খাতের ব্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে প্রশিক্ষণ ব্যয়। এমন তো নয় যে বিবিএস প্রথমবারের মতো এই জরিপ করছে। এর আগেও এমন জরিপ করা হয়েছে। সেই দক্ষ লোকবল কোথায় গেল? তা ছাড়া এখানে ১০৭টি সেমিনার কেন করতে হবে? আর সার্ভার ক্রয়, সেটা তো বিবিএসের অবকাঠামোতে আগেই থাকা উচিত। সব কিছু মিলিয়ে এই প্রকল্পের ব্যয়ের কাঠামো প্রশ্নবিদ্ধ।

জাহিদ হোসেন বলেন, প্রতিটি প্রকল্পের জন্য আলাদা করে কেন কম্পিউটার কিনতে হবে? এক প্রকল্পের ডিভাইস ব্যবহার করে পরবর্তী প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করা যেতে পারে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/09/02/1314191