২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৭:৫২

আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেল

আড়াই বছরের প্রকল্প শেষ হয়নি ৭ বছরেও

ভারতীয় অর্থায়ন ৪২০.৭৬ কোটি টাকা

সাত বছরেও হয়নি বাংলাদেশের আখাউড়া থেকে ভারতের আগরতলা পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথ অথচ সোয়া ১৪ কিলোমিটারের এই রেলপথ তৈরির কাজ আড়াই বছরে শেষ করার কথা ছিল। সেভাবেই প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে প্রকল্পটি হাতে নেয়। অর্থায়নটা ছিল ভারত সরকারেরই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পটির মেয়াদ বারবার বাড়ানোর পরও ধীরগতিতেই হচ্ছে নির্মাণকাজ। সর্বশেষ পঞ্চম দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ শেষ করার জন্য সময় নেয়া হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এতে মেয়াদ উন্নীত হলো ৮ বছরে। গত সাত বছরে প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৮৮ শতাংশ। ফলে বর্ধিত সময়ের মধ্যেও ১২ শতাংশ কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলছেন, যেসব প্রকল্পের কাজ ৭০-৯০ শতাংশ সমাপ্ত হয়েছে, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে শেষ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।

রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, নির্মাণাধীন আখাউড়া-আগরতলা রেল লিংকটির মাধ্যমে দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। উদ্দেশ্য হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারসহ পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে রেল পরিবহনের আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন, বাংলাদেশের আখাউড়া হয়ে ভারতের কলকাতা এবং আগরতলার মধ্যে নতুন রেল সংযোগ স্থাপন করা এবং রফতানি নির্ভর ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসারের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন। এছাড়াও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক এবং উপ-আঞ্চলিক কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে একটি নতুন করিডোর স্থাপনের লক্ষ্যে বিবেচ্য এলাকাকে প্রকল্প এলাকা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালের অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটির মোট প্রকল্প ব্যয় ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। যার মধ্যে ভারতীয় ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। জুলাই ২০১৬ হতে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ২ বছরে সমাপ্ত করার কথা ছিল। কিন্তু এখন সেটা দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ৮ বছরে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি একনেক সভায় প্রকল্পটির মেয়াদ আর না বাড়ানোর শর্তে অনুমোদন দেয়া হয়।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, আখাউড়া থেকে আগরতলার নিশ্চিন্তপুর পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালের ২১ মে ভারতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেক্সমেকো রেল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সাথে চুক্তি হয়। দুই দেশের এই রেলপথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ৬ দশমিক ৭৮ কিলোমিটার। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই প্রকল্পের কাজ শুরু করে। প্রকল্পের মূল মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আড়াই বছর। এরপর করোনা মহামারীর কারণে প্রথমে জুলাই ২০১৬ হতে জুন ২০২০, এরপর জুলাই ২০১৬ হতে জুন ২০২১, তৃতীয়বার জুলাই ২০১৬ হতে জুন ২০২২, ৪র্থ বার জুলাই ২০১৬ হতে জুন ২০২৩ এবং পঞ্চমবার জুলাই ২০১৬ হতে জুন ২০২৪ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

প্রকল্পের আওতায় মূল কাজ হলো, বাংলাদেশ অংশে ১০.০১ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ মেইন লাইন এবং ৪.২৫ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ লুপলাইন নির্মাণ। ৫৬.৫১ একর ভূমি অধিগ্রহণ, তিনটি মেজর ব্রিজ ও ২০টি মাইনর ব্রিজ নির্মাণ, তিনটি স্টেশনে কম্পিউটারাইজড ইলেকট্রনিক সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন ইত্যাদি।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, উপমহাদেশের রেল নেটওয়ার্ক ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি করা হয়েছে। সে সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আটটি ইন্টারচেঞ্জ রুট ছিল। ১৯৬৫ সালের পর থেকে এগুলো অব্যবহৃত থেকে যায়, কিন্তু এর মধ্যে চারটি রুট চালু করা হয়েছে। চালু করা রুটগুলো হচ্ছে, বেনাপোল-পেট্রাপোল, দর্শনা-গেদে, রোহানপুর-সিঙ্গাবাদ ও বিরল-রাধিকাপুর। এর মধ্যে বিরল-রাধিকাপুর রুট গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে উদ্বোধন করা হয়। এ ছাড়া দর্শনা-গেদে রুট দিয়ে যাত্রী ও মালামাল পরিবাহিত হয়। আর ১৪ এপ্রিল ২০০৮ থেকে দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করছে।

প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, কোভিড-১৯ এর জন্য ২০২০ সালের ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশ ও ভারতে লকডাউন জারি করায় সাইটের কাজ একই বছর জুন পর্যন্ত বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে জুলাই ২০২০ হতে স্বল্প পরিসরে কাজ চালু হলেও ২০২১-এ পুনরায় লকডাউন চালু হওয়ায় মাঠ পর্যায়ের কাজ বন্ধ ছিল। প্রকল্পটি ভারতীয় অনুদানে বাস্তবায়িত হচ্ছে। অনুদানের শর্ত অনুসারে প্রকল্পের কাজ সম্পাদনের জন্য ভারতীয় ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে ভারতীয় লোকবল কর্মরত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে লক ডাউন ও চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় মাঠপর্যায়ের কাজের বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটেছে। মন্ত্রণালয় আরো বলছে, অনুদানের শর্ত অনুসারে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নির্মাণ সামগ্রী, মালামাল, ইক্যুইপমেন্ট প্লান্টস্ প্রভৃতি ভারত হতে আনতে হয়। কোভিড-১৯ এর কারণে স্লিপার এবং অন্যান্য মালামাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নিয়োজিত ঠিকাদার কর্তৃক ভারত হতে নির্মাণসামগ্রী আমদানি করতে বিলম্ব হয়েছে। এছাড়াও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মরত লোকবল ভারত হতে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করতেও অসুবিধা হওয়ায় প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে ইতোমধ্যে নির্মিত রেললাইন, সিগন্যালিং যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য স্থাপনার ভুলত্রুটি চিহ্নিতকরণ ও প্রয়োজনীয় সংশোধনের লক্ষ্যে কমপক্ষে বছর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড (ডিএলপি) প্রয়োজন। নিযুক্ত ঠিকাদারের কাছ থেকে প্রকল্পের পূর্তকাজের ত্রুটি সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও চূড়ান্ত বিল পরিশোধের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য বর্ধিত মেয়াদের প্রয়োজন রয়েছে।

আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেল সংযোগ নির্মাণ (বাংলাদেশ অংশ) প্রকল্পের ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ রেলপরিবহন উইং বলছে, নির্মাণ কাজের ঠিকাদারের সাথে সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে না। প্রকল্পের কাজ নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করতে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত মেয়াদে ঠিকাদার নির্মাণকাজ সম্পাদনে ব্যর্থ হলে চুক্তির সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ এবং পিপিআর অনুযায়ী ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে প্রকল্পের সব অঙ্গের কাজ সম্পন্ন করতে হবে এবং প্রকল্পের মেয়াদ আর কোনো অবস্থায়ই বৃদ্ধি করা হবে না বলে তাদের বলা হয়েছে।

আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েলগেজ রেলপথ প্রকল্পের পরিচালক (বাংলাদেশ অংশ) মো: আবু জাফর মিয়ার সাথে মুঠোফোনে প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি গতকাল নয়াদিগন্তকে বলেন, বর্ধিত যে সময় নতুন করে এক বছর পাওয়া গেছে, তা পুরোটা লাগবে না। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করতে পারব। চলমান কাজগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, এখন ব্যালাষ্টিংয়ের কাজ চলছে। বিল্ডিংগুলোও হয়ে গেছে। ফিনিশিংএর কাজ চলছে। মেইন যে কাজ ট্রাকিং, সেটা শেষ হয়ে গেছে। ট্রেন চলাচলের জন্য যেসব ব্যবস্থা দরকার সেগুলো সবই সম্পন্ন হয়েছে। এতোটা বেশি সময় লাগলো কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত করোনার কারণেই কাজটা পিছিয়ে গেছে। এই প্রকল্পের সব কিছুই ভারতীয়। করোনার কারণে তারা এবং মালামাল আমদানি বন্ধ ছিল। আর ২ বছর কাজ বন্ধ থাকলে কাজ তিন বছর পিছিয়ে যায়।


https://www.dailynayadiganta.com/last-page/774216