১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৩৮

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা চলবেই

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

ব্রিকস সম্মেলনে যোগদান শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ঢাকায় ফিরে গত মঙ্গলবার সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বরাবরই বিদেশ সফর শেষে এরকম একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। নিয়মানুযায়ী এসব সংবাদ সম্মেলনে থাকার কথা বিভিন্ন মিডিয়ায় কর্মরত রিপোর্টারদের। কিন্তু সাধারণত আমরা দেখতে পাই যে, সম্পাদকরা সামনের সারিতে জাঁকিয়ে বসে আছেন। সাধারণত বসে থাকাই সার। কেউ কেউ এখানে প্রধানমন্ত্রীর অতীত বর্তমান কর্মকান্ডের ভূয়সি প্রশংসা করে তাদের বক্তব্য শেষ করেন। কিন্তু প্রশ্ন কী করেন, সেটা খুঁজে পাওয়া যায় না। দু’একজন প্রশ্ন করেন বা তাদের প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হয়। প্রশ্নটা আগে ধরিয়ে দেওয়া হয় কিনা, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

প্রধানমন্ত্রীর এবারের সংবাদ সম্মেলনে অনেক প্রশংসাই উঠে এসেছে। তারমধ্যে ডিমের মূল্য বৃদ্ধি, ডাবের মূল্য বৃদ্ধি, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা এবং ব্রিকসে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি না হওয়া প্রভৃতি বিষয় স্থান পেয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে কোনো সমস্যার কথা উঠলেই ত্বরিত সমাধানের পথ বাতলে দেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। রমজানে যখন বেগুনের দাম বেড়ে গিয়েছিলো বেগুনি তৈরির জন্য তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন বেগুনির ফালির বদলে কুমড়ার ফালি দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে ইফতারির উপকরণ। অনেকেই তখন ঐ সম্ভাব্য উপকরণের নাম দিয়েছিলেন কুমড়ানি। কিন্তু বেগুনির বদলে কুমড়ানি খেয়েছে এরকম লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বলতে পারছি না প্রধানমন্ত্রী যেসব ইফতার পার্টি দিয়েছিলেন তাতে ইফতারিতে বেগুনির বদলে কুমড়ানি পরিবেশন করা হয়েছিলো কিনা। একইভাবে মাছ মাংসের দাম যখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেল, তখন প্রধানমন্ত্রী মাংস না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বললেন মাংসের বদলে কাঁচা কাঁঠাল খাওয়া যেতে পারে। তিনি আমাদের জানালেন বিদেশে নাকি কাঁঠালের বার্গার তৈরি হয় এবং মানুষ বেশী দাম দিয়ে ভিড় করে সেসব বার্গার খেয়ে থাকে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন কাঁঠালের বার্গারের দামও নাকি বেশী। কিন্তু মাছ মাংসের বার্গারের চাইতে কাঁঠালের বার্গারের দাম যদি বেশী হয় তবে সেটা কে খাবে? সাধারণত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ-তরুণীরা বার্গার কিনে খান। বাসায় যদি কেউ কাঁঠালের বার্গার তৈরি করেন তাহলে সে খবর প্রকাশিত হতো। সরকারের তোষামোদকারী সাংবাদিকরা পুরা পাতা জুড়ে উপসম্পাদকীয় স্তম্ভ রচনা করতেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে একেবারে কাছাছোলা প্রশংসা করা হতো। কিন্তু সে রকম দেখিনি। ফার্স্ট ফুডের দোকানিরা এমন কি ফেসবুক, ইউটিউবেও কাঁঠালের বার্গারের কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করেনি। ফার্স্ট ফুড ভক্ত আমার ছেলে-মেয়েদেরও জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তারা কেউ কাঁঠালের বার্গার খায়নি। এমন কি কোনো দোকানের মেন্যুতেও তা দেখেনি। তবে কাঁচা কাঁঠাল দিয়ে মাংসের তরকারি আমি নিজেও খেয়েছি। সিজনে অনেক পরিবারেই মাংস দিয়ে কাঁঠাল রান্না হয়। তবে কাঁঠালের তরকারি বেশ পপুলারই মনে হয়। কারণ সিজনে কাঁচা কাঁঠাল মাঝ বরাবর কেটে দোকানে বিক্রি হতে দেখেছি। তরকারি খাওয়ার জন্য যাদের পুরো কাঁঠালের প্রয়োজন নেই তারা অর্ধেকটা কাঁঠাল কেনেন। গরিবের মাছ বলে খ্যাতি আছে পুকুরের পাংগাসের। বছরখানেক আগেও এসব পাংগাসের কেজি ছিলো দেড়শ’ টাকা এখন বাড়তে বাড়তে তা আড়াইশ’ তিনশ’ টাকায় উঠেছে। অজুহাত, মাছের খাদ্যের দাম বেড়েছে। কেউ যদি সিন্ডিকেট করে মাছের খাদ্যের দাম বাড়ায় তা হলে অপর কেউ কেন মাছের দাম বাড়াবে না।

এরপর এলো কাঁচা মরিচ। সত্য যে বৃষ্টিতে মরিচ গাছের গোড়ায় পানি জমে মরিচ ক্ষেতের ক্ষতি হয়েছিলো। ফলে ব্যবসায়ীরা মরিচের দাম সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিলেন। মরিচের কেজি হাজার টাকায় উঠলো। তখন প্রধানমন্ত্রী বা সরকার আমদানি করে মরিচের সরবরাহ বাড়ানোর চিন্তা না করে নতুন পরামর্শ দিলেন। এমনও অনেক মানুষ আছেন যারা বিশেষ করে দুপুরের খাবার খেতে বসেন কাঁচা মরিচের বাটি পাশে নিয়ে তাদের জন্য এটা খুবই দুঃসংবাদ। কিন্তু এখানেও সরকারের পরামর্শ হচ্ছে যখন কাঁচা মরিচের দাম কম থাকে সে সময় কিনে শুকিয়ে ফ্রিজে রেখে দিন। তারপর প্রয়োজন মতো বের করে খেয়ে নেবেন। পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার কথা বলেছিল সরকার। খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার বলেছিলেন তিনি পেঁয়াজ ছাড়া আঠারো পদের রান্না করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী তো তার পাচকদের বলে দিয়েছিলেন পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করতে।

কাঁচা মরিচ শুকালে তা শুকনো মরিচে পরিণত হবে। সেগুলো আর কাঁচা খাওয়ার যোগ্য থাকবে না। যে কাঁচা মরিচ খায় তাকে দিয়ে কিছুতেই শুকনো মরিচ খাওয়ানো যাবে না। তবু কেন সমস্যা মোকাবিলার জন্য এইসব আজগুবি সমাধানের চেষ্টা। সরকার মসনদে বসে থাকবেন, ভোগান্তি পোহাতে হবে জনগণকেই।

বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পেছনে সরকার লেগেই আছে। তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলাই দিয়ে যাচ্ছে সরকার। অনেক সময় মনে হয় কোনো এক ধরনের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য এসব মামলা দেয়া হচ্ছে। ইউনূসকে হয়রানি না করার জন্য শতাধিক নোবেলজয়ী সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। সরকার সে চিঠিতে সাড়া দেয়নি। বরং ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা অব্যাহত রাখে। এর পেছনে কারণ কী তা নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। সরকারের কথাবার্তায় অনেক সময় মনে হতে পারে যে কী এমন কারণ আছে যার জন্য সরকার ড. ইউনূসের পেছনে লেগেই আছে। সম্প্রতি নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি ফের বাংলাদেশ সরকারের কাছে এক চিঠি লিখেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা বলেছেন, আত্মবিশ্বাস থাকলে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না। সরকার এরকম চিঠি বিবৃতি পরোয়া করে না। ট্যাক্স দেয়া সব নাগরিকের দায়িত্ব। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে ট্যাক্স ফাঁকি দিলে কাউকে ছাড় দেয় না সে দেশের সরকার। বাংলাদেশেও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের মামলা আইন অনুযায়ী চলবে। ভদ্র লোকের যদি এতোই আত্মবিশ্বাস থাকে যে, তিনি অপরাধ করেননি তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না। এরকম বহু নোবেল বিজয়ী আছেন যাদের পরবর্তীতে কারাগারেও যেতে হয়েছে। তিনি ড. ইউনূসের বিদেশের বিনিয়োগ ও অন্যান্য খরচ বিষয়ে সন্ধিগ্ধ প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, এরকম বহু নোবেল বিজয়ী আছেন যাকে পরবর্তীতে কারাগারে যেতে হয়েছে। তবে নেটে অনুসন্ধান করে একটিমাত্র উদাহরণ পাওয়া গেছে। তিনি হলেন বেলারুশের মানবাধিকার কর্মী অ্যালেস বায়ালিয়াটস্কি। ২০২৩ সালের মার্চে চোরাচালান এবং শান্তি শৃংখলা রক্ষা বিরোধী কাজ করায় বেলারুসের একটি আদালত তাকে দশ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এসব অভিযোগ আগেও করেছেন। তবে ঢাকাস্থ ইউনূস সেন্টার বিবৃতি দিয়ে এই অভিযোগগুলোর জবাব দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, ইউনূস যে বিদেশ ভ্রমণ করেন তার সামগ্রিক ব্যয়ভার আমন্ত্রণকারীরাই বহন করেন। তাছাড়া তিনি নোবেল পুরস্কারের অর্থ তো পেয়েছেনই ফলে তাকে কোনো অর্থ বিদেশে নিয়ে যেতে হয়নি। তিনি বরং ঐসব অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে আয়ও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে তাদের কোলে তুলে নাচে? এ ভাষায়ই বোঝা যায় ইউনূসের বিরুদ্ধে সরকারের মামলা জোরেশোরেই চলবে। বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের যেমন তেমনি ড. ইউনূসকে সরকার দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু কেন? সে কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি না।

https://www.dailysangram.info/post/534226