১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৩৩

কারসাজিতে বাড়ছে টিকিটের দাম

বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক বিভিন্ন গন্তব্যে উড়োজাহাজের ভাড়া বেশ বেড়েছে। এই খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কারসাজি করে মধ্যপ্রাচ্যের টিকিটের দাম বাড়ানো হচ্ছে। পুরো মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করছে ১৫টি ট্রাভেল এজেন্ট সিন্ডিকেট। তারা আগাম টিকিট ব্লক করায় বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ যাত্রী।

সাত-আট মাস আগে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক বিভিন্ন একমুখী গন্তব্যে যে ভাড়া ছিল, এখন তা বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে অন্যান্য গন্তব্যের যাত্রীদের টিকিটেও।

যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার টিকিটের দাম বেশ বেড়েছে। চীনের গুয়াংজুসহ কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি প্রসিদ্ধ নগরে যেতে চড়া মূল্যে কাটতে হচ্ছে টিকিট।

এতে প্রবাসী শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও অন্যদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
করোনা মহামারির সময় ভ্রমণসহ স্বাস্থ্যগত বিধি-নিষেধে আকাশপথে যাত্রী কম ছিল। তখন থেকে এই ভাড়া বাড়তে শুরু করে। করোনা সংকট উতরে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।

আকাশপথে যাত্রীও বেড়েছে, তবে ভাড়া না কমে উল্টো আরো বাড়তি।
ট্রাভেল এজেন্টদের সূত্রে জানা গেছে, সাত-আট মাস আগে যেখানে সৌদি আরবের জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, মদিনা, আরব আমিরাতের দুবাই, কাতার, ওমান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য গন্তব্যে যেতে ইকোনমি ক্লাসের একমুখী ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, এখন সেখানে গুনতে হচ্ছে প্রায় দুই লাখ টাকা।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে হয়। বড় এজেন্সিগুলোর মধ্যপ্রাচ্যের সিট ব্লকের কারণে অন্য গন্তব্যগুলোতেও টিকিটের দাম বেড়ে যায়। তারা ঢাকা থেকে দুবাই ব্লক করলে দুবাই থেকে নিউ ইয়র্ক, কানাডাসহ অন্য গন্তব্যের টিকিট পাওয়া যায় না।

এতে দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের।
তিনি বলেন, এয়ারলাইনসগুলো বাল্কে (গ্রুপ টিকিট) সিট বিক্রি করে কয়েক মাস আগেই মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে যাচ্ছে। ছোট এজেন্সিগুলো বেশি টাকা দিয়ে বড় এজেন্সির কাছ থেকে চড়া দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে পুরো মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করছে ১৫টি ট্রাভেল এজেন্ট সিন্ডিকেট। এই আগাম সিট কেনা বন্ধ হলে পরিস্থিতি বদলে যেত। এয়ারলাইনস ও ট্রাভেল এজেন্টদের সিন্ডিকেট আগাম টিকিট ব্লক করায় বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ যাত্রী।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা-নিউ ইয়র্ক, ঢাকা-টরন্টো রুটে ভাড়া অনেক বেড়েছে। বেশির ভাগ বিমান সংস্থা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে এসব গন্তব্যে যায়। ঢাকা-নিউ ইয়র্ক ১ সেপ্টেম্বর কাতার এয়ারওয়েজের একমুখী ভাড়া তিন লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু ঢাকা থেকে দোহা রুটের ভাড়া এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এই রুটে ৩০ আগস্ট টার্কিশ এয়ারলাইনসের একমুখী ভাড়া তিন লাখ ৯ হাজার, ছয় মাস আগেও যা ছিল এক লাখ টাকার মধ্যে।

ঢাকা-টরন্টো রুটে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ৩০ আগস্ট একমুখী ভাড়া পাঁচ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। কাতার এয়ারওয়েজের সাত লাখ ৩৪ হাজার টাকা, এমিরেটসের এই দিনের ভাড়া ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এই গন্তব্যে ৭ অক্টোবর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একমুখী ভাড়া এক লাখ ৮৬ হাজার টাকা। দ্বিমুখী ভাড়া দুই লাখ ৫৭ হাজার টাকা।

জানতে চাইলে একটি ট্রাভেল এজেন্সির শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বড় এজেন্সিগুলোর হাতে জিম্মি টিকিটের বাজার। এখন বেশি প্রবাসী শ্রমিক যাচ্ছেন মালয়েশিয়ায়। কিন্তু এই রুটের সব টিকিট কয়েকটি এজেন্সি মিলে কিনে রেখে দিয়েছে, আমরা টিকিট পাচ্ছি না।’

ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈশ্বিকভাবে আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে পিক সিজন। এই সময় ছাত্রসহ প্রবাসফেরতদের চাকরিতে যোগ দেওয়ার চাপ বেশি থাকে। শিক্ষার্থী ও ছুটির যাত্রীর চাপ এখন প্রায় ৯০ শতাংশ। বাড়তি চাপ সামাল দিতে বড় ফ্লাইট না চালিয়ে এয়ারলাইনসগুলো ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। ফলে যাত্রীদের বেশি দামে টিকিট কিনতে হচ্ছে। এই খাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।’
বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর দাবি, ডলারের উচ্চমূল্য, জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধিসহ পরিচালন ব্যয় বাড়ার কারণে টিকিটের মূল্য বাড়ছে। আবার ডলার সংকটের কারণেও বাংলাদেশ থেকে তারা টিকিট বিক্রির অর্থ নিজ দেশে নিতে পারছে না। এ কারণে তারা বাংলাদেশে ফ্লাইট কমিয়েছে।

এই সংকট কাটাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি দেশি এয়ারলাইনসের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘যে পর্যন্ত দেশি বিমান সংস্থাগুলো শক্তিশালী না হবে, তত দিন আমরা বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর কাছে জিম্মি থাকব।’

মধ্যপ্রাচ্যে চলাচলকারী দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চাহিদার বিপরীতে আসন এখনো অনেক কম। এদিকে জ্বালানিসহ পরিচালন ব্যয় করোনার আগের অবস্থায় নেই। এ কারণে ভাড়া বাড়ছে।’

প্রবাসী কর্মীদের ভাড়া নিয়ে আর্থিক ক্ষতি কমাতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তৎপরতা চলছে। বাংলাদেশে চলাচলকারী সব এয়ারলাইনসকে ১ জুলাই থেকে ডলারের পরিবর্তে টাকায় ফ্লাইটের ভাড়া নির্ধারণের নির্দেশনা দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমে যাওয়ায় যেসব যাত্রীকে তুলনামূলক বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছিল, তাদের জন্য এই উদ্যোগ কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসবে।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাড়া নির্ধারিত হয় চাহিদার ওপর। এখন চাহিদা বেড়েছে, ক্যাপাসিটি সেই হারে বাড়েনি। অনেক এয়ারলাইনস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আসনসংখ্যা কমে গেছে। ভাড়া শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে বেশি। ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে আনতে আমরা এয়ারলাইনসগুলোকে বলে আসছি, বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/09/01/1313922