১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৭:২৯

আগস্টে ডেঙ্গু সংক্রমণ সবাইকে বিস্মিত করেছে

আক্রান্ত ৭২ হাজার মৃত্যু ৩৪২

আগস্টে ডেঙ্গু সংক্রমণ বিস্মিত করেছে সবাইকে। এর আগে এক মাসে এত মানুষ ডেঙ্গু ভাইরাসে যেমন আক্রান্ত হয়নি, তেমনি এক মাসে এত মৃত্যুও হয়নি। আগস্ট মাসের ৩০ দিন ৮ ঘণ্টায় (গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশে ৭১ হাজার ৯৭৬ জন মানুষ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৩৪২ জন। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, মূলত মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ ছিল না। যেসব পদ্ধতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের অন্যান্য স্থানের স্থানীয় সরকার পরিষদ যেভাবে মশা নিধনের চেষ্টা করেছে, সেগুলো সঠিক ছিল না, সেগুলো কার্যকর পদ্ধতিও নয়। বিদেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবং মশা নিধনে গবেষণা জোরদার করে একটি কার্যকর পদ্ধতি বের করা সম্ভব ছিল। কিন্তু গতানুগতিক পদ্ধতি ছাড়া এ দেশে কিছুই হয়নি। ফলে গেল আগস্টে ৩৪২ জন মানুষের মৃত্যু হলো। এ বছরের গত আট মাসে ৫৯৩ জনের মৃত্যু হলো এবং গত আট মাসে মোট এক লাখ ২৩ হাজার ৮০৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে।

আগস্ট মাসটি ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার সংক্রমণের মৌসুম। আজ থেকে শুরু হওয়া সেপ্টেম্বর মাসটি ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে ধরা হলেও আগামী অক্টোবরের পুরো মাসটিতেও ডেঙ্গু থাকার কথা জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্যবিদ ও রোগতত্ত্ববিদ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আগস্ট মাসে যে ৩৪২ জন মানুষ ডেঙ্গুতে মারা গেছে এবং প্রায় ৭২ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, জনস্বাস্থ্যবিদ ও রোগতত্ত্ববিদ হিসেবে কি আপনি বিস্মিত হয়েছেন? প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি বিস্মিত হইনি, কিন্তু ব্যথিত হয়েছি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিধনে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা ‘ভুল’। আমাদের দেশে মশক নিধনে ফগিংকে (মেশিন দিয়ে কীটনাশকযুক্ত ধোঁয়া ছড়ানো) খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু ফগিংয়ের চেয়ে লার্ভিসাইডিংয়ের প্রতি বেশি জোর দেয়া উচিত ছিল। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, যেভাবে ফগিং করা হচ্ছে আমাদের দেশে তাও ভুল পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে কুল (শীতল) ফগিং করা হয়, এটাও সঠিক পদ্ধতি নয়। এখানে হট (গরম) ফগিং করা হলে তা হবে বেশি কার্যকর। হট ফগিং করা হলে তাতে একটু তাপ থাকবে, এই তাপটা মশা নিধনে আরো বেশি কার্যকর। তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় হট ফগিং করা হয়।

ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, পানিতে লার্ভিসাইডিংয়ের ওপর আমাদের জোর দেয়া উচিত। কারণ মশা তো পানিতেই ডিম পাড়ে এবং সেখানেই এগুলোকে মেরে ফেলতে পারলে মশক নিধনে অনেক বেশি কার্যকর হবে। তিনি বলেন, উড়ন্ত মশা মারার প্রতি জোর দিতে হবে কিন্তু তার চেয়ে বেশি জোর দিতে হবে লার্ভিসাইডিংয়ের ওপর। বিটিআই দিয়ে লার্ভিসাইডিং বিষয়ে ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, বিটিআই কার্যকর একটি পদ্ধতি কিন্তু আমাদের দেশের জন্য কতটুকু কার্যকর গবেষণা করে দেখে নিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।

ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর আরেকটি কারণ হলো ডেঙ্গুর যে ৪টি স্ট্রেইন আছে সবগুলো স্ট্রেইনই কার্যকর এবং সবগুলো দিয়েই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং সংক্রমণও বেশি এবার।

ডেঙ্গুর এতো মৃত্যু ও সংক্রমণ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা: এম মোজাহেরুল হক গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এবারের ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যু একই সাথে বিষ্ময়ের ও অচিন্তনীয়। কোনো দেশে ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যু ও আক্রান্ত হয় না। তিনি বলেন, আমরা আগে থেকেই জানি যে, এই সিজনে ডেঙ্গুর বংশবৃদ্ধি ও সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি। তা ছাড়া ডেঙ্গুর ব্যাপারে আমাদের রয়েছে গত ২২ বছরের অভিজ্ঞতা। তারপরও আমাদের কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা নেই রোগটির ব্যাপারে। ডেঙ্গু সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু দু’টি মন্ত্রণালয়ই তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ডেঙ্গু বিষয়ে জনসচেতনতায় প্রচুর অর্থ খরচ হচ্ছে কিন্তু এ বিষয়ে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি সরকার। প্রতিটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জন প্রতিনিধিদের সাথে নিয়ে সরকারের উচিত ছিল জনপ্রতিনিধিদের সাথে জনগণকে নিয়ে মশক নিধনে কাজ করা। এই এখন শহর থেকে গ্রামের দিকে ডেঙ্গু বিস্তৃত হচ্ছে এটা আগেই ঠেকানো যেতো।

জনস্বাস্থ্য ডা: আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন, আমি বিষ্মিত হয়েছি সংক্রমণে। দায়িত্বশীলরা মশক নিধনে কার্যকর উদ্যোগ নিলে এতো মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্ত হতো না। কিন্তু মশা মারার প্রতি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমাদের নজরে পড়েনি গতানুগতিক কাজ ছাড়া। ডা: আহমেদ পারভেজ জাবীনও মনে করেন, ঢাকা অথবা সারা দেশেই মশক নিধনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্তদের আরো দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসা করুন যেন মানুষের মৃত্যু কমে আসে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/773998