৩০ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১১:৫৪

তিস্তা এখন দিল্লী এবং কলকাতার রাজনীতির হাতিয়ার

লেখক কাশেম বিন আবু বাকার সম্পর্কে কিছু লেখার ইচ্ছে ছিল। কারণ কয়েকদিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। পক্ষে বিপক্ষে তুমুল আলোচনা। তবে দেখলাম, পক্ষের সংখ্যাই বেশি। ফেসবুকের সেই আলোচনা থেকেই জানা গেল যে, তাকে নিয়ে ৭১ টেলিভিশনে টক’শো হয়েছে। সেই টক’শোর উপস্থাপিকা থেকে শুরু করে অন্যরা নাকি তার তীব্র সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, তার লেখা নাকি নিম্নমানের এবং অশ্লীল। অন্যেরা বলছেন যে, তার লেখায় নাকি রয়েছে ইসলামী ফ্লেভার। এসব আলোচনা ও সমালোচনা থেকেই জানা গেল যে, তিনি নাকি অন্তত ১০০টি উপন্যাস লিখেছেন। তারাই বললেন যে, এতদিন তিনি ছিলেন অজ্ঞাত। কেউ তার নাম জানতো না। অথচ, গ্রামে-গঞ্জের হাজার হাজার মানুষ নাকি তার বই পড়ে এবং গ্রামে-গঞ্জে তিনি নাকি লেখক হিসাবে অসাধারণ জনপ্রিয়। অথচ তিনি শহুরে লোকদের কাছে বিশেষ করে ঢাকার শহুরে মানুষদের কাছে ছিলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি নাম। তাই অন্যদের সাথে আমারও দুর্ভাগ্য যে আমি সাহিত্যিক হিসাবে কাশেম বিন আবু বাকারের নাম শুনিনি। সুতারং তার কোনো বই পড়ারও সৌভাগ্য আমার হয়নি। সেজন্য আজ তার সাহিত্য কর্ম নিয়ে কোনো আলোচনা আমি করতে পারছি না।

গতকাল শনিবার ঢাকার একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে পূর্ণ পৃষ্ঠার একটি ফিচার প্রকাশিত হয়েছে। ঐ ফিচারটি পড়ে এই লেখক সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেল। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক কিছু জানা গেছে। এটি জানা গেল যে, কাশেম বিন আবু বাকার সম্পর্কে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি তার সম্পর্কে বাংলাদেশের শহরে এবং গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করেন। অতপর ঐসব তথ্য সম্বলিত একটি বিশাল ফিচার ইংল্যা-ের বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি মেইলে’ প্রকাশিত হয়। ডেইলি মেইলের এই বিশাল ফিচার প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের একশ্রেণীর মিডিয়ার টনক নড়ে। তারাও এই লেখক সম্পর্কে খোঁজ খবর শুরু করেন। ৭১ নামক টেলিভিশনটি বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের কাছে একটি বিশেষ ঘরানার টেলিভিশন হিসাবে চিহ্নিত। সেই টেলিভিশনের একটি টক’শোতে কাশেম বিন আবু বাকারের সাহিত্য কর্মকে নাকি অশ্লীল বলা হয়েছে। আমি বিষয়টি চেক করার জন্য এমন দুই একজনের সাথে যোগাযোগ করি যারা তার বেশ কিছু লেখা পড়েছেন। তার লেখার বিরুদ্ধে ২১শে টেলিভিশন এবং তথাকথিত প্রগতিবাদীরা যা কিছু বলছেন সে সম্পর্কে আলোচ্য ঐ দু এক ব্যক্তি আমাকে কিছু পড়িয়ে শোনান। বেশ কিছুক্ষণ লেখকের বইয়ের উদ্ধৃতি শোনার পর আমার মনে দু একটি প্রশ্ন এসেছে। আমি তসলিমা নাসরিনের প্রায় সবগুলো বই পড়েছি। পড়েছি হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন’ বইসহ আরো অনেকগুলো বই। আরো পড়েছি সৈয়দ সামছুল হকের ‘খেলারাম খেলে যা’।
এসব লেখকের লেখাকে শুধুমাত্র অশ্লীল বললে কম বলা হবে। বরং বলা যায় ওদের অনেকগুলো লেখা রীতিমত পর্ণগ্রাফি। ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, ‘পর্ণ লিটারেচার’। তাদের অধিকাংশ লেখাতেই নরনারীর দৈহিক মিলনের যে বিস্তারিত এবং রগরগে বর্ণনা দেয়া হয়েছে সে তুলনায় কাশেম বিন আবু বাকারের যে সব উদ্ধৃতি শুনলাম সেগুলো রীতিমত নস্যি। কিন্তু প্রগতিবাদের তকমা আঁটা একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এবং একশ্রেণীর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া সৈয়দ সামছুল হক, হুমায়ুন আজাদ বা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার একটি অভিযোগও উচ্চারণ করেন নাই। অথচ এখন তারা লেগে পড়েছে কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে। এই লেখকের বয়স এখন ৮০। অশতিপর এই বৃদ্ধ এখন বেশ অসুস্থ এবং গত দুই বছর হলো তিনি আর কলম চালাতে পারেন না। আজ তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হচ্ছে সেসব অভিযোগের জবাব দেয়ার শারীরিক ক্ষমতা তার নাই। মিডিয়ার কেউ যদি মেহেরবানী করে তার কাছে যায়, তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে এবং সেই সাক্ষাৎকার পুরাটাই ছাপায় বা প্রকাশ করে তাহলে জনগণ তুলনামূলক পর্যালোচনার সুযোগ পাবে। কিন্তু একটি প্রশ্নের জবাব প্রগতিবাদীদেরকে দিতে হবে। তসলিমা নাসরিন, সৈয়দ সামছুল হক বা হুমায়ুন আজাদের লেখার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার একটি অভিযোগও তারা মুখ ফুটে উচ্চারণ করলেন না, কিন্তু কাশেম বিন আবু বাকারের সাহিত্য ওদের তুলনায় বলতে গেলে এমন কিছু না থাকলেও কেন তারা তাকে নিন্দিত করার জন্য মাঠে নেমেছেন? সামাজিক মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে, কাশেম বিন আবু বাকারের সাহিত্যে রয়েছে ইসলামী আবহ। সেজন্যই কি তিনি প্রগতির ধ্বজাধারী সমালোচকদের আক্রমণের নিশানা হয়েছেন? এ সম্পর্কে আজ আর কিছু বলবো না। যদি কাশেম বিন আবু বাকারের লেখাগুলো পড়ার সুযোগ পাই তাহলে তখন তার প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসবো। এখন যাচ্ছি অন্য প্রসঙ্গে।
॥দুই॥
আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো এই যে, তিস্তার পানি পাওয়ার আশা এখন বাংলাদেশের জন্য সুদূর পরাহত। বাংলাদেশের জন্য বিষয়টি এখন অনেকটা হয়েছে সেই প্রবাদ প্রবচনের মতো, ‘ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলাও’। তিস্তার পানিতো দূরের কথা, ভারত এখন হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের আত্রাই নদীর পানির ওপর।
মঙ্গলবার দুপুরে কোচবিহারের কামতাপুরি পিপসল পার্টির দেয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, “আত্রাই নদীতে বাঁধ দিয়ে জল আটকে দেয়া হচ্ছে। এর জন্য বালুর ঘাটে জল নেই। বালুর ঘাট অঞ্চলের মানুষদের বিশেষ করে কৃষকদের দারুণ সমস্যা হচ্ছে। আমি বাংলাদেশের বন্ধু সরকারকে অনুরোধ করবো, আত্রাই নদীর জলটাকে কেন বাঁধ দিয়ে আটকাচ্ছেন, ওটা ছেড়ে দিন। আমাদের বালুরঘাটের লোকেরা জল পাচ্ছে না।”
মমতা ব্যানার্জি তিস্তা নিয়ে সোমবার দেয়া কিছু সংবাদ মাধ্যমের খবর নিজেই সংশোধন করেন। সোমবার কোচবিহারের স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কিছু সংবাদপত্রে একটু অন্যরকম করে খবর করা হয়েছে বলেও জনসভায় অভিযোগ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

তাঁর ভাষায়, “আমি সাংবাদিক ভাইদের বলছি, গতকাল কয়েকজন সাংবাদিক ভাই আমাকে তিস্তা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এবং এরপর আমি যা বলেছি সেটা নিয়ে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে একটা অন্যকম খবর দেয়া হয়েছে। আমি পরিষ্কার বলতে চাই, আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। যেখানে জল নেই সেখান থেকে জল কি করে দেবো আমরা। আমি বলেছিলাম, যেখানে জল আছে সেখান থেকেই জল দেয়া যেতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “মানাইসা হয়ে ধানসাই হয়ে জল নিয়ে যান আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি বাংলাকে ভালবাসি এবং বাংলাদেশকেও ভালবাসি। বাংলাদেশ আমার বন্ধু দেশ।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বাংলাদেশের জন্য কিছু করিনি বললে ভুল হবে। ফারাক্কার জলও আমরা দিয়েছিলাম। ফারাক্কার কারণে কত গ্রাম চলে গেছে জলে। পশ্চিম বঙ্গকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকার যে টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই টাকা কেন্দ্র আজও দেয়নি। ফারাক্কা এখন শুকিয়ে গেছে, কলকাতা বন্দর শুকিয়ে গেছে, ড্রেজিং পর্যন্ত করা হয়নি।”
মমতা ব্যানার্জির এসব কথা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের কয়েকদিন আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বলেছিলেন যে, তিস্তা চুক্তি নিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা রয়েছে। ভারতের মতো ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজ্য সরকারের সাথে কেন্দ্রকে মিলেমিশে কাজ করতে হয়। সমস্যাটি যে রাজ্যের সেই রাজ্যের সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো সমাধান কেন্দ্রীয় সরকার ঐ রাজ্যের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। তিস্তা পশ্চিম বঙ্গের ব্যাপার, তাই পশ্চিম বঙ্গের সম্মতি ব্যতিরেকে কেন্দ্র কোনো সমাধান পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের ওপর চাপিয়ে দিতে চায় না। এই কথা বলেন প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু ভারতের সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদ বিশেষ করে ২৫৩ নম্বর অনুচ্ছেদ সেকথা বলে না। এই অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রয়োজনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বৃহত্তর স্বার্থে রাজ্যকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো দেশের সাথে চুক্তি করতে পারে।
বাংলাদেশী এবং ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মতে তিস্তা প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার মমতা ব্যানার্জির সরকারকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের সাথে এই চুক্তি করতে চাচ্ছেন না। আসল কথা হলো, এখানে কাজ করছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।

বাংলাদেশ এবং ভারতের একশ্রেণীর রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের চোখ রয়েছে আগামীতে অনুষ্ঠিতব্য পশ্চিম বঙ্গ বিধান সভার নির্বাচনের ওপর। পশ্চিম বঙ্গে এখনো তৃণমূল কংগ্রেস বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি। পর পর দুটি বিধান সভা নির্বাচনে জয় লাভ করে মমতা ব্যানার্জি রাজ্য সরকার গঠন করেছেন। তার চোখ এখন পরবর্তী নির্বাচনের ওপর। এই নির্বাচনে জয়লাভ করে তিনি তার রাজ্যে তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করতে চান।
পক্ষান্তরে বিজেপির চোখও এখন পশ্চিম বঙ্গের ওপর। উত্তর প্রদেশে জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও এবং মুসলমানদের ভোট প্রার্থনা না করেও বিজেপি উত্তর প্রদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেছে। সেই কৌশল এবার তারা পশ্চিম বঙ্গে প্রয়োগ করতে চায়। পশ্চিম বঙ্গের জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ মুসলমান। তাদের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ এই মুহূর্তে মমতার তৃণমূলের সমর্থক। মমতার মুসলিম ভোট ব্যাংকে খুব সহজেই ভাগ বসাতে পারবে বলে বিজেপি মনে করে না। তারা মুসলমানদের ভোট ছাড়াই হিন্দুদের একচেটিয়া ভোটে জয়লাভ করতে চায়। সেজন্য তারা প্রয়োগ করতে চায় হিন্দুত্বের হাতিয়ার। উত্তর প্রদেশে এই হাতিয়ার প্রয়োগ করেই তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। পশ্চিম বঙ্গেও হিন্দুত্বের জিগির তুলে বিজেপি একই ফল লাভ করতে চায়।

মমতা ব্যানার্জি বিজেপির এই কৌশল ধরতে পেরেছেন। সেজন্য তিনিও পূর্বাহ্নিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। কয়েকদিন আগে তিনি বিহারে জগন্নাথের মন্দিরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন যে, তিনিই খাঁটি হিন্দু। বিজেপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে চায়।
এমন একটি রাজনৈতিক পটভূমিতে তিস্তার পানি হয়েছে ভোটের রাজনীতির অন্যতম প্রধান ইস্যু।
নরেন্দ্র মোদি সংবিধানের ২৫৩ ধারা প্রয়োগ করে বাংলাদেশের সাথে তিস্তা চুক্তি করতে পারেন। কিন্তু করতে চান না। তিনি মমতার ঘারে বন্দুক রাখতে চান। কিন্তু চুক্তির দায় নিতে চায় না বিজেপি। মমতাও এ রাজনীতি ভালভাবে বুঝেন। আর মমতা ব্যানার্জিও তিস্তা প্রশ্নে বর্তমানে যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন সেই ভূমিকায় অটল থেকে প্রমাণ করতে চান যে, পশ্চিম বঙ্গবাসীর স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে তিনি আপোষহীন। বিজেপি এবং তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছে তিস্তার পানি বন্টন।
Email: asifarsalan15@gmail.com

http://www.dailysangram.com/post/281935