২১ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ৬:২৯

১৩ বছরে ১১ হাজার শ্রমিকের মৃত্যু

কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় গত ১৩ বছরে ১১ হাজার ৪৮১ জন শ্রমিক মারা গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন নির্মাণ শ্রমিক। এই সময়ে এ খাতে মারা গেছেন দুই হাজার ৩০৪ জন শ্রমিক। শতাংশের হিসাবে তা মোট শ্রমিক মৃত্যুর ২০ শতাংশ।
এর পরই আছে পোশাক খাত। এ খাতে মারা গেছেন এক হাজার ৭০৪ জন শ্রমিক। শতাংশের হিসাবে তা মোট শ্রমিক মৃত্যুর ১৪.৮ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে আছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত।

যেমন—লেদ মেশিনের কারখানার মতো ছোট কারখানাগুলো।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। বিলসের এই তথ্যের ভিত্তি মূলত পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া খবর।

বিলসের হিসাবে, চলতি বছরের গত ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) শুধু নির্মাণ খাতে মারা গেছেন ৪২ জন শ্রমিক।
আহত হয়েছেন ৬৯ জন। তাঁদের সবাই পুরুষ শ্রমিক।

জাতীয় বিল্ডিং কোডে কর্মকালীন একজন শ্রমিককে কী কী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। ২০১৪ সালের জাতীয় ভবন নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, কাজের সময় কাজের শ্রমিকের মাথায় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। যাঁরা কংক্রিটের কাজে যুক্ত, তাঁদের হাতে গ্লাভস এবং চোখের জন্য ক্ষতিকর কাজে চশমা পরিধান করতে হবে।
ওয়েল্ডার ও গ্যাস কাটার ব্যবহারের সময় রক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন—গ্লাভস, নিরাপত্তা বুট, অ্যাপ্রন ব্যবহার করতে হবে। ভবনের ওপরে কাজ করার সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তায় বেল্ট ব্যবহারও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

শ্রমিক দুর্ঘটনার কারণের বিষয়ে জানতে চাইলে বিলসের নির্বাহী পরিচালক কহিনুর মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে নিরাপত্তাস্বল্পতা। তবে গত ছয় মাসের হিসাব দেখলে বলা যায়, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা কমছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ মালিক ও শ্রমিকরা আগের তুলনায় সচেতন হচ্ছেন। তিনি বলেন, শ্রম আইনের পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা দিতে হবে। এ আইন মানা হলে দুর্ঘটনা আরো কমবে।

বিলসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে কর্মক্ষেত্রে এক হাজার ৩৪ জন শ্রমিক নিহত এবং এক হাজার ৩৭ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। নিহতদের ৯৯ শতাংশ পুরুষ। কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকারও হচ্ছেন শ্রমিকরা। ২০২২ সালে ১৩৫ জন শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ ছিল নির্যাতন। এতে ১৫৫ জন আহতও হন।

গত বছর সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন পরিবহন খাতের শ্রমিক; ৪৯৯ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল নির্মাণ খাতে, ১১৮ জন। তৃতীয় স্থানে ছিল কৃষি খাত, ১১২ জন। এ ছাড়া দিনমজুর ৪৬ জন, কনটেইনার ডিপোতে ৪৪, মৎস্য ও মৎস্য শ্রমিক ৪৩ জন, ইলেকট্রিক শ্রমিক ২২ জন, নৌপরিবহন খাতে ১৫ জন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট শ্রমিক ১২ জন, ইটভাটা শ্রমিক ১০ জন, জাহাজ ভাঙা শিল্প শ্রমিক সাতজন, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি শ্রমিক ছয়জন এবং অন্যান্য খাতে ১০০ জন শ্রমিক মারা যান।

বিলসের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নির্মাণ শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় এটি এখন চরম ঝুঁকিপূর্ণ খাত। তবে এই খাতে মৃত্যু আগের চেয়ে কমছে। তাতে বোঝা যায়, নিরাপত্তার বিষয়ে মালিক-শ্রমিক উভয়ের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে।

তবে রাজধানীসহ সারা দেশে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রবণতা বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম সরবরাহ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। মালিক ও ঠিকাদারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদেরও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া উঁচু ভবনে কাজ না করার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। কারণ এই একজন শ্রমিকের ওপর তাঁর পুরো পরিবার নির্ভরশীল। শ্রমিকের মৃত্যু পুরো পরিবারকে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে ফেলে। পরিবারে শিশুদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।

নির্মাণ খাতের দুর্ঘটনার আরেকটি বড় দিক পথচারীর মৃত্যু। বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, সুরক্ষাব্যবস্থা না নেওয়ায় রড ও ইটের মতো সামগ্রী পড়ে আশপাশের মানুষ ও ভবনের নিচের পথচারীরা নিহত ও আহত হচ্ছে।

বিলস বলছে, মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব, শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এ আইনের দুর্বলতার কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

বিলসের পর্যবেক্ষণ হলো, নির্মাণকাজে ভালো সিঁড়ির অভাব এবং সিঁড়িতে পর্যাপ্ত আলোর অভাব, এলোমেলোভাবে রড, বালু ও ইট রাখা; কর্মক্ষেত্রে নেট ব্যবহার না করা অথবা দুর্বল নেটের ব্যবহার, কপিকলের ব্যবস্থা না থাকা, হেলমেট ও গ্লাভসের ব্যবস্থা না করা, খালি পায়ে কাজ করা, অসাবধানতা ও অসচেতনভাবে আবদ্ধ স্থানে প্রবেশ করা, প্রচণ্ড রোদে কাজ করা, ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার, বিশ্রাম কম; দুর্বল মাচা, দেওয়াল বা মাটি চাপা পড়া, ঝুলন্ত অবস্থায় কাজের সময় বেল্ট ব্যবহার না করা, ভালো জুতা বা বুট ব্যবহার না করা, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এবং ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।

ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, এই নির্মাণ খাতে ৩৭ লাখের বেশি পেশাজীবী যুক্ত। শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রম আইনে মালিক, শ্রমিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘শিল্প স্বাস্থ্য সেফটি কমিটি’ গঠন করতে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি কমিটি থাকলেও তৃণমূল পর্যায়ে এই কমিটি নেই। ফলে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা মালিকপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/08/21/1310398