৭ মে ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:২৫

উত্তরাঞ্চলে চার লেন প্রকল্পের ‘গলার কাঁটা’ ১৮ ওভারপাস

অনেক স্থানে নির্মাণকাজ শুরুই করা যায়নি

প্রকল্প শুরুর আট বছর পার। তবু শেষ হয়নি উত্তরাঞ্চল মহাসড়কের চার লেন প্রকল্পের ১৮ ওভারপাসের নির্মাণকাজ। এর মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী পয়েন্টে ওভারপাসের কাজ শুরুই করা যায়নি। ফলে ওভারপাসই এখন মহাসড়কটির ‘গলার কাঁটা’। নির্মাণকাজের ধীরগতির কারণ হিসেবে জমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতাকে দায়ী করছে কর্তৃপক্ষ। এ প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে আগামী ডিসেম্বরে। এ স্বল্প সময়ে পুরো কাজ শেষ হবে কিনা– তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহযোগিতায় ২০১৬ সালে টাঙ্গাইল-রংপুর ১৯০ কিলোমিটার মহাসড়কে চার লেনের কাজ শুরু হয়। চার লেন পুরোপুরি চালু হলে স্বল্প সময়ে পৌঁছানো যাবে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায়। প্রকল্পটির নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। কথা ছিল, ২০২১ সালের আগস্টে টানা হবে কাজের যবনিকা। মেয়াদ পার হলেও কাজের অগ্রগতি না থাকায় বাড়ানো হয় প্রকল্পের মেয়াদ, সঙ্গে বাড়ে খরচও। এখন ৪ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা বেড়ে ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার প্রকল্প এটি। আর কাজ শেষ করার নতুন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ডিসেম্বর।

প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন এ মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করে। সম্প্রসারণ কাজের জন্য মাঝেমধ্যেই বেশ কয়েকটি পয়েন্টে দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। বিশেষ করে ঈদ এলে পরিস্থিতি জটিল রূপ নেয়। কিছুদিন পরই কোরবানির ঈদ। এর আগে নির্দিষ্ট পয়েন্টের কাজ শেষ করা না গেলে ভোগান্তির শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২)। এটিকে আধুনিক একটি মহাসড়ক মনে হলেও মূল উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি এবং সাসেক করিডোর, এশিয়ান করিডোর, বিমসটেক করিডোরে যুক্ত হওয়া।

কাজের বর্তমান হাল
বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকে রংপুর মডার্ন মোড় পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, মহাসড়কের একাধিক পয়েন্টে ওভারপাস নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি। কোনো কোনো ওভারপাসের কাজ শুরু থেকেই ফেলে রাখা হয়েছে। যেসব এলাকায় ওভারপাসের নির্মাণকাজ এখনও চলছে, এর মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ অংশে ইকোনমি জোন, কড্ডার মোড়, ঝাওইল, ঘুড়কা, ভূঁইয়াগাতী, রায়গঞ্জ ক্রসলেন; বগুড়া অংশে চান্দাইকোনা বাজার, ধনকুণ্ঠি, ছোনকা, মীর্জাপুর ও মেডিকেল কলেজ; গাইবান্ধা অংশে গোবিন্দগঞ্জ বাজার, গাইবান্ধা মোড়, পলাশবাড়ী বাজার এবং রংপুর অংশে পীরগঞ্জ বাজার, মিঠাপুকুরের বলদীপুকুর বাসস্ট্যান্ড, শঠিবাড়ী ও বড় মির্জাপুর।

মূল মহাসড়ক হচ্ছে চার লেনের। এর দুই পাশে থাকছে সার্ভিস লেন। সিরাজগঞ্জ অংশে যমুনা সেতু পার হয়ে উত্তর পাশে নতুন করে রেলস্টেশন করা হচ্ছে। রাস্তার বাঁ পাশে হচ্ছে সিরাজগঞ্জ ইকোনমি জোন। এটার ঠিক সামনেই হচ্ছে ওভারপাস। সেখানে চলছে র‍্যাম্পের কাজ, ফাঁকা পিলার দাঁড়িয়ে আছে। এখানে গার্ডার লাগানোর পর সড়ক সংযুক্ত করা হবে। সামনে কড্ডার মোড়ে হচ্ছে ফ্লাইওভার। এখানে মূল সড়কের পাশে যে সার্ভিস লেন, সেখানে কার্পেটিংয়ের কাজ হয়েছে। মহাসড়কের বেশির ভাগ অংশে চার লেনে যানবাহন চলছে। আবার কোথাও কোথাও দুই পাশে যে সার্ভিস লেন রয়েছে, সে পথ ধরেও চলছে গাড়ি। এ লেনগুলো মূল সড়ক থেকে একটু নিচু করা হয়েছে। এ কারণে চলাচলে কিছুটা বিঘ্ন হচ্ছে।

হাটিকুমরুল মোড়ে ইন্টারচেঞ্জ কাজ চলমান থাকায় সেখানে মাঝে মাঝে জট লাগছে। সেখানে এখন পিলারের কাজ চলছে। হাটিকুমরুল অংশটিতে যেসব ভবন ছিল, সেগুলো ভাঙা হয়েছে। যানবাহনের চালক ও যাত্রী বিশ্রামের জন্য মহাসড়কের এ অংশে নির্মাণ করা হচ্ছে হাইওয়ে সার্ভিস এরিয়া। বগুড়ার বনানী থেকে মির্জাপুর পর্যন্ত ২২ কিলোমিটার পর্যন্ত রাস্তার বিপজ্জনক এলাকার বনানীর হাট, মাঝিড়া, ক্যান্টনমেন্ট ও নয়মাইল এলাকায় এখনও সাইড রোডের কাজ শেষ হয়নি। এ অংশের ঠিকাদার কনকর্ড প্রগতি কনস্ট্রাকশনের (সিপিসিএল) প্রকৌশলী মোহাম্মাদ রিয়াজ বলেন, শ্রমিকরা ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। শিগগির আমরা কাজ শেষ করতে পারব।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহাসড়কের বগুড়া অংশের ৪৫ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭ স্থানে যানজট দেখা দেয়। এর মধ্যে অন্যতম মাডিডালি বিমান মোড়, গোকুল, টিএমএসএসের হোটেল মমইন, বাঘোপাড়া, নওদাপাড়া, বনানী, তিনমাথা, মাঝিড়া, ফটকি ব্রিজ, ফুলতলা, মেডিকেল কলেজ, বি-ব্লক, আড়িয়া উল্লেখযোগ্য। এখন বনানী, মাডিডালি, গোকুল, নওদাপাড়া এবং টিএমএসএস এলাকায় কাজের গতি কম। এ অংশের কাজের ঠিকাদার মনিকো কনস্ট্রাকশনের প্রকৌশলী আসাদুজ্জামানের দাবি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তারা কাজ শেষ করতে পারবেন।

প্রকল্প শুরুর আট বছর পর ভবন ভেঙে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ মাত্র শুরু করা হয়েছে গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী অংশে। এ পয়েন্টে ওভারপাসের কাজে এখনও হাতই দেওয়া হয়নি। রংপুরের মিঠাপুকুরের দমদমা ব্রিজ থেকে বৈরাগীগঞ্জ পর্যন্ত সড়কের নির্মাণকাজ এখনও চলছে। দক্ষিণে বলদীপুকুর বাসস্ট্যান্ড আন্ডারপাসের নির্মানকাজ শেষ হয়নি। এখানে গড়েরমাথা পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশের এক পাশে কাজ হয়নি। এর পর উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত বাণিজ্যিক হাট শঠিবাড়ী। হাটের এক কিলোমিটার অংশজুড়ে নির্মাণকাজ শুরুই করা যায়নি। এ হাটেরই দক্ষিণ অংশে নির্মাণ করা হচ্ছে আন্ডারপাস। দুই কিলোমিটার দূরে বড় মির্জাপুর আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে আন্ডারপাসের নির্মাণকাজও চলমান রয়েছে। পায়রাবন্দের ইসলামপুর এলাকায় স্বয়ংক্রিয় টোল প্লাজার নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে অন্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।

কর্তৃপক্ষ যা বলছে
সাসেকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যমুনা সেতুর পূর্ব ও পশ্চিমে ১৩ ও ৩০ কিলোমিটারের দুটি প্যাকেজ রয়েছে। এখানে কাজের গতি খুবই মন্থর। সব মিলিয়ে এ দুই প্রকল্পে ৫০ শতাংশ কাজও করা যায়নি। গোবিন্দগঞ্জে সম্প্রতি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে বড় বাজার রয়েছে। এগুলো ভাঙার কাজ চলছে। এ জন্য অনেক দেরি হয়েছে।

সাসেক-২ প্যাকেজ-৮-এর কর্মকর্তা নাশিদ হাসান সিরাজী জানান, মহাসড়কের চার লেনের কাজ শেষ হলে উত্তরাঞ্চলের শিল্প-বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন আসবে।

বগুড়ার শেরপুর থেকে শাজাহানপুরের বনানী পর্যন্ত সড়কের চার লেন উন্নয়ন কাজ ৮ নম্বর প্যাকেজের (শেরপুরের মির্জাপুর থেকে বনানী) আওতায় করা হচ্ছে। এ কাজ করছে সিপিসিএল তান্তিয়া জেভি কোম্পানি। প্রকল্পের শুরুতে এ অংশে জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১৯ মাস কাজ করতে পারেনি। এ প্যাকেজের ব্যবস্থাপক মামুন কায়সার বলেন, আমাদের অংশে বেশ কয়েক একর জমি অধিগ্রহণ করা যায়নি। এ জন্য নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

সাসেক-২ প্রকল্প পরিচালক ড. ওয়ালিউর রহমান বলেন, করোনার কারণে প্রকল্পটির কাজ বেশি দেরি হয়েছে। এখন আমরা কাজে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। প্রকল্পের কাজের মধ্যে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা অংশে ৭৫ শতাংশ ও হাটিকমুরুল থেকে রংপুর পর্যন্ত ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, যা গড়ে ৭৮ শতাংশ হবে। আশা করছি, নতুন করে কাজের সময় আর বর্ধিত করা লাগবে না।

https://samakal.com/bangladesh/article/235949