২১ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ৬:২৭

অপরাধের নীল দংশন

স্কোপোলামিন বা ডেভিলস ব্রেথ (শয়তানের নিঃশ্বাস) এমনই এক ভয়ঙ্কর উপাদান যা কারো অজান্তে কিংবা কৌশলে, জোর করে কিংবা অপকৌশলে অথবা শক্তিপ্রয়োগে কারো নিঃশ্বাসের মাধ্যমে একবার মানবদেহে ছড়িয়ে দিতে পারলেই সব শেষ। তিনি কয়েক মিনিটের জন্য হয়ে যান অপরাধীর নিয়ন্ত্রণাধীন। বর্তমান সময়ে এটি দেশে এক আতঙ্কের নাম। ডেভিলস ব্রেথ কিংবা শয়তানের নিঃশ্বাস একবার প্রয়োগেই কার্যকারিতা থাকে ১৫ থেকে ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত। তরল পদার্থ প্রয়োগে এর কার্যকারিতা থাকে আরো বেশি সময় ধরে। অপরাধ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, শয়তানের নিঃশ্বাস নামের এ উপাদানের অপব্যবহার করে অপরাধী কারো সম্পদ লিখে নেয়া, আবার কোনো নারীর সর্বনাশ করে নীল ছবি তৈরি অথবা পছন্দের নারীকে বিয়ে করলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ এটি যার ওপর প্রয়োগ করা হয় তিনি তখন নিজের মধ্যে থাকেন না। তার সামনে যিনি থাকেন, তিনি যা বলবেন তা-ই করবেন।

পুলিশ সদর দফতর থেকে বলা হয়েছে, প্রতারণায় যেহেতু শয়তানের নিঃশ্বাস নতুন সংযোজন, তাই এ সম্পর্কে এখনই পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না। তবে এটি নিয়ে পুলিশ মাঠে কাজ করছে। কোথা থেকে এটা আসে এবং কারা জড়িত তাদের সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হচ্ছে।

শয়তানের নিঃশ্বাস প্রতারক চক্রের শিকার দেশের ভুক্তভোগীর সঠিক তথ্য নেই পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে। তবে এ পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের অন্ততঃ ত্রিশটি জেলায় এ ধরনের ঘটনায় মামলা হয়েছে। প্রথমদিকে মানুষ এ সম্পর্কে জানতেন না। সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনার প্রেক্ষিতে বিষয়টি সামনে আসে। এরপর থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, শয়তানের নিঃশ্বাস নামক ভয়ঙ্কর এ পদার্থের অপব্যবহারের বিষয়টি সবাই অনুধাবন করলেও এটি আসলে কী, কোন কাজে ব্যবহার হয় এবং কোথা থেকে আমদানি করা হচ্ছে, তা নিশ্চিত করতে পারছে না কেউ।

জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, রাষ্ট্র যখন জনকল্যাণে ধারাবাহিকভাবে কার্যকর বা অবদান রাখতে পারে না তখন এ ধরনের সমস্যা বাড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। শয়তানের নিঃশ্বাস নিয়ে যা হচ্ছে এটি একটি ক্রাইম। কিন্তু এ উপাদান কোথা থেকে আসে, কারা জড়িত জনস্বার্থে সেটি রাষ্ট্র খুঁজে বের করবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে কিছু জানে না- এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। এটি সতর্কতার সাথে ডিল করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (নিরোধ ও শিক্ষা) মানজারুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, শয়তানের নিঃশ্বাস নামে উপাদানটি মানবদেহে শারীরিক ও মানসিক নির্ভরশীলতা তৈরি করে না। এছাড়া ইউএন কনভেশন অনুযায়ীও এটি ড্রাগ নয়। মাদকের ২০১৮ সালের আইনেও এটি সিডিউলভুক্ত মাদক নয়। সর্বমোট ৩৩টি কেমিক্যাল মাদকের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যেও নেই স্কোপোলামিন বা শয়তানের নিঃশ্বাস। তবে এটি অপপ্রয়োগে যেহেতু মানুষ হতবুদ্ধ হয়ে পড়ে, কিছু সময়ের জন্য ভুক্তভোগীর কাছে যা চাওয়া হয় তা-ই দিয়ে দেয়, তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অবস্থান এটির বিরুদ্ধে। তার মতে, এটি একটি কেমিক্যাল। এটি এর আগে মেডিসিন পারপাসে ব্যবহার হয়েছে বলে তার স্ট্যাডিতে রয়েছে। কাজেই এটি যাতে দেশে ঢুকতে না পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের উপ-ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) এসএম আব্দুল্লাহ আল মাসুদ বলেন, প্রডাকশন রিলেটেড কিছু কেমিকেল আমাদের আমদানি করা হয়। শয়তানের নিঃশ্বাস সম্পর্কে জানা নেই।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের উপ-পরিচালক ও সরকারি বিশ্লেষক মো. মোস্তফা কামালও এটি নিয়ে কোনো বিস্তারিত ধারণা দিতে পারেননি।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ প্রকৌশলীরা বলেছেন, তারা ২৭৬টি পণ্যের জাতীয় মান নিয়ে কাজ করেন। এ পণ্য আমাদের মধ্যে পড়ে না। তার পরে এটি সংগ্রহ করে কেউ আমাদের ল্যাবে পাঠালে আমরা পরীক্ষা ও গবেষণা করবো।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম পরিচালক খন্দকার আল মঈন ইনকিলাবকে বলেন, গণমাধ্যম থেকে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। জেনেছি এটির অপপ্রয়োগে জ্ঞানবুদ্ধি লোপ পায়। এটি দেশে কিভাবে ঢুকলো সে বিষয়ে সঠিক তথ্য নেই। ধারণা করছি, আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের মাধ্যমে আসতে পারে। আমরা এ ধরনের কোনো অভিযানে যাইনি। তবে বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। ভুক্তভোগী কিংবা কারো মাধ্যমে অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব। তবে এ ধরনের প্রতারক চক্রের কবল থেকে নিজেকে রক্ষায় সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

শয়তানের নিঃশ্বাস এমন একটা উপাদান যা কোনো ধরনের অস্ত্র কিংবা ভয়ভীতি না দেখিয়েও টার্গেট ব্যক্তির সব কিছু লুটে নিতে পারে অপরাধীরা। পাউডার কিংবা তরল জাতীয় এ পদার্থ কোনোভাবে কারো নিঃশ্বাসে নিতে পারলেই ভুক্তভোগী সম্পূর্ণরূপে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান। তাদের কথামতোই রোবটের মতো কাজ করেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, এটি নিয়ে গবেষণার সময় এসেছে। তবে আপাতত জনসাধারণকে এটির অপব্যবহার করে কেউ যাতে প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য সকলকে সচেতন হতে হবে।
সম্প্রতি রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী প্রিয়া, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা সদরের হৃদয় টেলিকমের মালিক দুলাল মিয়া ও দোকানে থাকা তার ভাগ্নের চোখে কিছু একটা লাগিয়ে দেয়া হয়। এরপরই তারা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ৮ এপ্রিল অভয়নগর উপজেলায় দোকান মালিক শরিফুলের বাবা, ২১ জানুয়ারি পল্লবীর ১২ নম্বরের ডিওএইচএস কমপ্লেক্সে ট্রাভেল এজেন্সির জিসান, ফরিদপুর শহরে আলেয়া বেগমসহ ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক ভুক্তভোগী এ চক্রের কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হন।
পল্লবীর মামলার তদন্ত করতে গিয়ে দেশে এ ধরনের ৮-১০টি গ্রুপের সন্ধান পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রতি গ্রুপে দুই থেকে তিনজন করে সদস্য আছে। এসব চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে ইরানি নাগরিকরা।

এদিকে অপরাধ বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, স্কোপালামিন মাদক মস্তিস্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। অন্যের দেয়া আদেশকে যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ করতে বাধ্য করা হয় স্বেচ্ছায়। দুর্বৃত্তরা লোকজনকে সর্বস্বান্ত করতে মোক্ষক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এটি। সম্প্রতি এ চক্রের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা ইনকিলাবকে বলেন, এটি এমন একটি ভয়ঙ্কর জিনিস যার প্রয়োগে রিমোট কন্ট্রোল থাকে অপরাধীর হাতে। মেক্সিকানরা এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন এটির অপব্যবহার হচ্ছে।

উল্লেখ্য, শয়তানের নিঃশ্বাস নামক এ মাদকের উৎপত্তি কলম্বিয়ায়। ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট লাদেনবার্গ ‘সত্যের সিরাম’ অর্থাৎ সত্যের সন্ধানে এর ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯২২ সালে এটি কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে এ মাদকটি প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে। পর্নোগ্রাফি বা নগ্নছবি তোলার কাজেও অপরাধীরা এটি ব্যবহার করে। স্কোপোলামিন তরল ও শুকনো দুই আকারেই পাওয়া যায়। এ ড্রাগটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। সাধারণত এর প্রতিক্রিয়া থাকে ২০ থেকে ৬০ মিনিট। খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে প্রতিক্রিয়া থাকে দু-তিন দিন পর্যন্ত।

https://dailyinqilab.com/national/article/596375