২০ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১১:০৬

মন্ত্রী-সচিবদের পিএস থেকে ডিসি ২২ জন

দেশের ৬৪ জেলা প্রশাসক বা ডিসির মধ্যে ২২ জনই বর্তমান কোনো না কোনো মন্ত্রী ও সচিবের একান্ত সচিব বা পিএস ছিলেন। নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার সম্প্রতি ৩০ জনকে ডিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাতজন মন্ত্রী বা সচিবের পিএস হিসেবে কাজ করেছেন।

বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে সরকারের অধিক আস্থাশীল কর্মকর্তা হিসেবে এঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিপরীত তথ্য হলো এই ৬৪ জেলা প্রশাসক বিএনপি-জামায়াত সরকার এবং এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়কের সময় নিয়োগ পেয়েছিলেন। এঁরা বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭ প্রশাসন ব্যাচের কর্মকর্তা।

বর্তমানে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪ ব্যাচের ২৪ জন, ২৫ ব্যাচের ২১ জন এবং ২৭ ব্যাচের ১৭ জন কর্মকর্তা ডিসি হিসেবে কর্মরত। এর মধ্যে ২৪ ও ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা বিএনপি সরকারের সময়ে নিয়োগ পান।

ওই নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল। তত্ত্বাবধায়কের আমলে নিয়োগ পাওয়া ২৭ ব্যাচ নিয়েও ছিল বিতর্ক। তাই একবার এই ব্যাচের ফলাফল বাতিলও করা হয়েছিল।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বড় কোনো ব্যতিক্রম ঘটলে নির্বাচনের আগে এই ৬৪ ডিসির মধ্যে কাউকে পরিবর্তন করা হতে পারে।

সে ক্ষেত্রেও যিনি বা যাঁরা ডিসি হবেন তাঁরা এই তিন ব্যাচের রিজার্ভ ফোর্সে থাকা ১২৫ কর্মকর্তার মধ্য থেকেই হবেন।
ডিসিদের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মন্ত্রী-সচিবের পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ২২ জন ছাড়া ডিসি পদে যোগদানের আগে সরাসরি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন ১১ জন কর্মকর্তা। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাতজন, অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঁচজন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগে চারজন করে এবং জননিরাপত্তা বিভাগে দুজন। বাকি ৯ জন কর্মকর্তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত ছিলেন।

পিএস থেকে ডিসি হওয়া ২২ কর্মকর্তা হলেন—খুলনায় কৃষিমন্ত্রীর পিএস খন্দকার ইয়াসির, সাতক্ষীরায় পরিকল্পনামন্ত্রীর পিএস মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, পটুয়াখালীতে আইনমন্ত্রীর পিএস নূর কুতুবুল আলম, নওগাঁয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস গোলাম মওলা, নোয়াখালীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস দেওয়ান মাহবুবুর রহমান ও পাবনায় মু. আসাদুজ্জামান, চাঁদপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পিএস কামরুল হাসান, খাগড়াছড়িতে খাদ্যমন্ত্রীর পিএস মো. সহিদুজ্জামান, মাদারীপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের পিএস মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান, বান্দরবানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের পিএস শাহ মোজাহিদ উদ্দিন, কুমিল্লায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পিএস খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান, নাটোরে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর পিএস আবু নাছের ভূঁঞা, বগুড়ায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর পিএস সাইফুল ইসলাম, যশোরে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর পিএস মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার, সুনামগঞ্জে ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর পিএস দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী, জামালপুরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ইমরান আহমেদ, ফরিদপুরে পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর পিএস কামরুল হাসান তালুকদার ও ভোলায় আরিফুজ্জামান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শিক্ষা উপমন্ত্রীর পিএস শাহগীর আলম, টাঙ্গাইলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পিএস কায়ছারুল ইসলাম ও নরসিংদীতে আবু নঈম মোহাম্মদ মারুফ খান এবং রাজশাহীতে জনপ্রশাসন সচিবের পিএস শামীম আহমেদ।

তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক থেকে মেহেরপুরের ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আজিজুল ইসলামকে চার মাসের ব্যবধানে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যোগদানের আগেই আদেশ বাতিল করে পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর পিএস আরিফুজ্জামানকে ভোলার ডিসি করা হয়। তাঁকে শরীয়তপুরের ডিসি করা হয়েছিল। শরীয়তপুর উপমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা। ফলে ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমালোচনা করছে।

২০১৮ সালে সরকার গঠনের পর কৃষিমন্ত্রীর তিনজন পিএস নিয়োগ পেয়েছিলেন, তিনজনই পরে ডিসি হয়েছেন। আইন, পরিকল্পনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর দুজন করে পিএস ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিসি নিয়োগে এখানে কোনো পক্ষপাত করা হয়নি। যাঁরা ডিসি হয়েছেন, তাঁদের নিয়োগ হয়তো অন্য সরকারের সময় হয়েছে। তবে যোগ্যতা অনুযায়ী সেরা কর্মকর্তাদের ডিসি বানানো হয়েছে।’ তিনি বলেন, মন্ত্রীদের পিএস নিয়োগ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। মন্ত্রীদের ইচ্ছামতো পিএস নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
মেধাতালিকার হালচাল

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়ন নীতিমালায় মাঠ প্রশাসনের এই নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা ও মেধাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হলেও তা মানা হয়নি। ডিসি হিসেবে নিয়োগ না পাওয়া ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যাঁরা ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে ছাত্রজীবনে সরকার দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। অভিযোগ আছে, ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা ২৭ ব্যাচের একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে এ ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তা ডিসি পদে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ, মেধাবী ও ছাত্রজীবনে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা কর্মকর্তারা বঞ্চিত হয়েছেন।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২৭ ব্যাচের মেধাতালিকায় প্রথম ৫০ জনের মধ্যে ডিসি হয়েছেন মাত্র চারজন। মেধাতালিকায় পেছনে থেকে ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ১৩ জন কর্মকর্তা।

একইভাবে ২৪ ব্যাচের সমিতির দুজন নেতার পরামর্শে বেশির ভাগ ডিসি নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এই ব্যাচেরও মেধাতালিকায় প্রথম ৫০ জনের মধ্যে ডিসি হয়েছেন মাত্র চারজন। মেধাতালিকায় পেছনের দিকে থেকে ডিসি নিয়োগ পেয়েছেন ২১ জন কর্মকর্তা।

২৫ ব্যাচে দুই গ্রুপের নেতাদের পরামর্শে মেধাতালিকায় প্রথমে থাকা ৫০ জনের মধ্যে ডিসি হয়েছেন সাতজন। মেধাতালিকার পেছন থেকে ডিসি হয়েছেন ১৪ জন।

সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে এভাবে নিয়োগ হচ্ছে। এর আগের সরকারের আমলেও এমন নিয়োগ হয়েছে। রাজনীতিতে আস্থার সংকট ও বিভাজন যত বাড়ছে, গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তা নিয়োগের মাত্রাও তত বাড়ছে।

https://www.kalerkantho.com/online/national/2023/08/20/1310072