২০ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১০:৩১

ভাঙনে সর্বস্বান্ত তিস্তা পাড়ের মানুষ

মোঃ লাভলু শেখ লালমনিরহাট থেকে : লালমনিরহাটের তিস্তা নদীতে তৃতীয় পর্যায়ে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। হামাক তিস্তার ভাঙন থাকি বাঁচান। এখন রিলিফ-স্লিপ কিছুই চাই না। নদীর বাঁধ চাই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের বাগডোরা গ্রামের আহিলা বেওয়া (৫৫)। শুধু আহিলা না তার মতো আরও অনেকে এখন নদী ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এরই মধ্যে ওই এলাকার ২৫ টি বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে নদীগর্ভে। পরিবারগুলো বাঁধের রাস্তায় ও অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে।

কয়েক দফা বন্যার পর তিস্তার পানি নেমে যাওয়ায় জেলার বেশ কিছু এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদী পাড়ের মানুষজন। হুমকির মুখে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুর, খুনিয়াগাছ বাগডোরা, আদিতমারী উপজেলার খুনিয়াগাছ, কালমাটি ও হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না গড্ডিমারি এলাকায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। এছাড়া তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকার কমপক্ষে ২০টি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এসব জায়গায় শতশত বসতভিটা, ফসলি জমি, গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার বাগডোরা গ্রামের বাসিন্দা এনামুল হক জানান, ভিটাবাড়ি আর বাবা-মায়ের কবর তিস্তা নদীতে ভেঙে গেছে। এছাড়াও ৪ বার বাড়ি ভেঙে গেছে। অন্যের জমিতে বাড়ি করে থাকি। কিছু টাকা জোগাড় করে একটা জমি কিনে বাড়ি করছি। সেই বাড়িও নদীতে ভেঙে গেল। এখন থাকার জায়গা নেই। যাওয়ারও কোনো পথ নেই। একই এলাকার গফুর মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ভাঙতে ভাঙতে মোর বাড়িটাও ভাঙিয়ে গেল। ৩দিন ধরে ঘুম নাই, খাওয়া নাই। পরিবার নিয়ে কই যামু কোনো দিশা পাই না। শফিকুল ইসলাম জানান, রোজগারের জন্য ঢাকায় ছিলাম। বাড়ির লোকজন ফোনে জানালো জমি-বাড়ি ও গাছপালা সব নদী ভাঙনে। তাই ছুটে এলাম। এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা চন্ডিমারীর বাসিন্দা খয়বর হোসেন জানান, তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় আবার নদী ভাঙন আতঙ্কে রয়েছি। সরকারী বরাদ্দে জিও ব্যাগ ফেললেও কাজে আসছে না। খুনিয়াগাছ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান ম-ল বাদল বলেন, উজান থেকে পানির সঙ্গে বালু এসে মূল নদী বন্ধ হয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফলে নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে দেখা দিয়েছে ভাঙন। ভাঙন কবলিত অনেক পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এসব পরিবারের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।

‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও’ সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাট জেলার সভাপতি শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে আমরা সভা-সমাবেশ করছি। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ এলাকার দুঃখ-দুর্দশা, নদী ভাঙন আর থাকবে না। নদী ভাঙন ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে দ্রুতই স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তার। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, দ্বিতীয় দফায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর এখন কমতে শুরু করছে। এতে করে লালমনিরহাট সদর উপজেলা ও আদিতমারী উপজেলার কয়েকটি পয়েন্টে দেখা দিয়েছে ভাঙন। তবে ভাঙন ঠেকাতে আপতকালীন কাজ হিসেবে বিভিন্ন পয়েন্টে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

গাইবান্ধা থেকে জোবাযের আলী: বন্যার পানি কমতে শুরু করায় গত বুধবার হতে তিস্তা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন আতংকে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ। নদী ভাঙ্গনরোধে স্থায়ী ও টেকসই ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভাঙনকবলিত এলাকাবাসী।

সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তার পানি কমে যাওয়ায় বেলকা, চন্ডিপুর, শ্রীপুর, হরিপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০০টি পরিবারের বসতবাড়ি এবং ৩০০ হেক্টর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে পাঁচশতাধিক বসতবাড়ি এবং কয়েক হাজার একর ফসলি জমি।

উপজেলার বেলকা চরের ফরমান আলী বলেন, নদী থেকে তার ঘরের দূরত্ব এখন মাত্র ৪ হতে ৫ হাত। যে কোন মুহূর্তে তার একমাত্র ঘরটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আতঙ্কে গত দু’দিন ধরে পরিজন নিয়ে রাতে ঘুমাতে পারছেন না। তিনি জানান, ৫ বার তার বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ষষ্ঠবারের মতো আবারো নদী ভাঙনের মুখে পড়েছে। বারবার নতুন করে বসতবাড়ি গড়তে গিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। দিনমজুরি করে কোনমতে সংসার চালান তিনি। ফের বসতবাড়ি সরিয়ে নেয়ারমত সম্বল নেই তার।

উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের লখিয়ার পাড়া গ্রামের জরিপ উদ্দিন বলেন, বন্যার পানি কমতে না কমতে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। তার বাড়ির আশপাশ গত দু’দিনে ১০টি পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে কমপক্ষে ২০টি পরিবার তাদের বসতবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। তিনি জানান, তার আমন ধানের চারা রোপণ করা ২ বিঘা জমি নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। ভাঙন অব্যাহত থাকলে আজকালের মধ্যেই বসতবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে।

কাপাসিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মনজু মিয়া জানান, তার ইউনিয়নে কমপক্ষে ৫০টি পরিবার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙনের মুখে পড়েছে হাজারও পরিবার। রাস্তা ভেঙে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে গেছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ালিফ মন্ডল জানান, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন ইউনিয়নে কমপক্ষে ১০০ পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে মর্মে তথ্য পাওয়া গেছে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়াম্যানদের কাছ থেকে ভাঙন কবলিত পরিবারদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক জানান, ভাঙন ঠেকাতে হরিপুর ইউনিয়নের কাশিমবাজার এলাকায় জিও টিউব ও জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ নুর-এ আলম জানান, উপজেলার বেলকা, হরিপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নে তিস্তার ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ভাঙনের মুখে পড়েছে অনেক পরিবার। ভাঙন কবলিত পরিবারগুলোকে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/533185