২০ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১০:২৭

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শেখ সেলিম অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলছেন

-আসিফ আরসালান

এসব কী ভয়ঙ্কর কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন? কথা বলার সময় তার স্মরণ রাখা উচিত যে, তিনি শুধুমাত্র একজন এমপি নন, তিনি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বটে। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ১৫ আগস্টের কথা বলতে গিয়ে এমন সব কথা বলেছেন যেসব কথা বিশ্ব রাজনীতির প্রধান তিন খেলোয়াড় আমেরিকা, রাশিয়া বা চীন বলে থাকে। এখন প্রধানমন্ত্রী দেশীয় রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে ভারত মহাসাগর এবং সেদিক দিয়ে অন্য দেশ আক্রমণের কথাও বলছেন। ঐ দিকে প্রধানমন্ত্রীর ফুপাতো ভাই, প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ সেলিমও এমন সব ভয়াল উক্তি করছেন সেগুলো শুনলে মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানি যখন ব্রিটেন আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল জার্মানির সামরিক হামলাকে বলেছিলেন Blood curdling threat অর্থাৎ রক্ত হিম করা হুমকি। Rich English বা সমৃদ্ধ ইংরেজি জানতে হলে পড়ুন স্যার চার্চিলের লেখা বই The Gathering Storm. অর্থাৎ যে কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে।

ওপরে যেসব কথা বলেছি সেসব ছাড়াও আরো কতগুলো ঘটনা ঘটেছে। একটি ঘটনায় দেখা যায় যে, সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বার এবং বেঞ্চ মুখোমুখি হওয়ার উপক্রম। আরেকটি খবরে দেখা যায় যে, একটি থানার ওসি একটি সমাবেশে প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। কতগুলো ঘটনা ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। কয়েক দিন আগে বিএনপির এ্যাক্টিং চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার পতœী জোবায়দা রহমানকে যথাক্রমে ৯ এবং ৩ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই বিএনপির সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রী এবং বিএনপি ঢাকা মহানগরী উত্তরের আহ্বায়ক আমানুল্লাহ আমান, কর্নেল অলি আহমেদের এলডিপির জেনারেল সেক্রেটারি রেদোয়ান আহমেদ প্রমুখকে ৩ বছরের বেশি কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। এসব কারাদন্ডের রাজনৈতিক তাৎপর্য এই যে, আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে এরা সব ডিসকোয়ালিফায়েড বা অযোগ্য হয়ে গেলেন। বেগম খালেদা জিয়া তো ১৭ বছরের দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সাল থেকেই অযোগ্য হয়ে বসে আছেন।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে কারাদন্ড দিয়ে রাজনীতি থেকে আউট করার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, বরং শুরু হয়েছে। শুক্রবারের পত্রিকায় দেখলাম, বর্তমানে বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশী সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমান এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ ৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও চিন্তাবিদকে ৭ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। আগামী ৭ বছর কারাদন্ড শেষ না হওয়া পর্যন্ত এরা কেউই আর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবেন না।

ঐ দিকে আল্লামা সাঈদী ইন্তেকাল করার পর ঢাকা, চট্টগ্রাম, চকোরিয়া, পিরোজপুর প্রভৃতি স্থানে মরহুমের গায়েবানা জানাযা পড়া নিয়ে পুলিশের সাথে জনতার যে সংঘর্ষ হয়েছে তার কারণে জামায়াতের সিনিয়র নেতা হামিদুর রহমান আজাদসহ অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২০ হাজার মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা সব মানবাধিকার সংস্থাসহ অনেকগুলো মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশের ওপর আরো বেশি করে স্যাংশন আরোপের দাবি জানিয়েছে। ওপরে যতগুলো ঘটনার কথা বললাম তার প্রত্যেকটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে গেলে প্রতিটি বিষয়ের ওপর আলাদা করে করে একটি করে কলাম লিখতে হবে। সেটি সম্ভব নয়। তাই আজকে সীমিত স্থানের মধ্যে যে ক’টি আলোচনা করা সম্ভব তাই করছি।

॥ দুই ॥
প্রথমেই আমরা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের কথা নিয়ে আলোচনা করবো। ১৫ আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্বজন হারানোর দুঃখ বেদনার কথা যখন বলেন তখন আমরা তার যথার্থতা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হই। কিন্তু মোমেন সাহেবরা ১৫ আগস্টের কথা বলতে গিয়ে যখন কিছু অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু ভয়াবহ আশঙ্কার কথা বলেন তখন সেটিকে ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ১৫ আগস্ট উপলক্ষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বক্তৃতা দেওয়ার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন তার শ্রোতাদেরকে হুঁশিয়ার করে দেন যে আরেকটি ১৫ই আগস্টের ঘটনার পুনরাবৃত্তি সম্পর্কে আপনারা সজাগ হোন। ১৬ই আগস্ট ইংরেজি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত খবর মোতাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। আমার সকল সহকর্মীকে এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার অনুরোধ করছি। আমরা আরেকটি ১৫ই আগস্ট ঘটুক, সেটা চাই না। এ ব্যাপারে আমাদের সকলকে হুঁশিয়ার হওয়ার সময় এসেছে। তিনি বলেন, আপনাদের হয়তো স্মরণ আছে যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ঘটনার পূর্বে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের জন্য একটির পর একটি ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বাড়ানো হয়েছিল। ঘটানো হয়েছিল বাসন্তির ঘটনা। তখন বাংলাদেশে বিদেশীদের আনাগোনা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল।

আজকের বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের অব্যবহিত পূর্বের ঘটনার মতো এমন সব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে যার ফলে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। কিছু সংখ্যক লোক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সেদিন ছিল এক বাসন্তির ঘটনা। আজ দৃশ্যপটে অনেক বাসন্তিকে আনা হচ্ছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, এই ধরনের অপপ্রচারের মোকাবেলা করার প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু আমরা অর্থাৎ আমাদের মন্ত্রণালয় সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি।

এর চেয়ে আরো মারাত্মক কথা বলেছেন শেখ সেলিম। আগেই বলেছি যে তিনি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু এটিই তার বড় পরিচয় নয়। তিনি শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই এবং মরহুম শেখ ফজলুল হক মনির আপন ভাই। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস শেখ মনির পুত্র এবং সেই সুবাদে শেখ সেলিম মেয়র তাপসের আপন চাচা। তার যে পরিচিতি দিলাম সেকারণে তার বক্তব্য হালকাভাবে নেওয়া যায় না। তিনি বলেছেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ভারতের পরলোকগত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার দেহরক্ষীদের গুলীতেই নিহত হয়েছেন। তার দাবি, শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার প্রতিপক্ষের লোক। তিনি দাবি করেন যে তিনি যে এসব কথা বলছেন, তার সপক্ষে তার ডকুমেন্ট আছে।
আমরা প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এবং শেখ সেলিম এমপির বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করবো। জনাব আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার হাতে তো অসীম ক্ষমতা। তিনি যখন জানেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা চলছে তখন সেই ধরনের ভয়ঙ্কর কথা বলেই কি তিনি বা তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করতে চান? তার কাছে যখন এই ধরনের ইনফরমেশন আছে যে, কিছু লোক আবার ১৫ই আগস্ট ঘটাতে চায় তখন তিনি বা তার সরকার এই ধরনের উত্তেজনাকর এবং ভয়ঙ্কর কথা বলে নীরব আছেন কেন? কেন ঐসব চক্রান্তকারীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না? কেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? কেন তাদের নাম ধাম প্রকাশ করা হচ্ছে না? কেন তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না?

বুঝতে কষ্ট হয় না যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আক্রমণের তীর ছুড়েছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য বিরোধী দলের দিকে। আমরা সাধারণ মানুষ, যারা দূর থেকে দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করছি, তারা দেখছি যে, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী কোনো গোপন রাজনীতি করছে না। বিগত বছরখানেক ধরে তারা আন্দোলন করছে। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় আন্দোলনের মধ্যে এক দিনের জন্যও তারা কোনো রকম সহিংসতার আশ্রয় নেয়নি। তারা কোনো বোমাবাজি করেনি, ককটেল ফাটায়নি। তারা কোনো গাড়ি ঘোড়া ভাঙচুর করেনি। এমনকি বছরের পর বছর গেছে, তারা এক দিনের জন্যও হরতাল ডাকেনি। তারা যতগুলো কর্মসূচী পালন করেছে তার কোনো কর্মসূচীই গোপনে পালন করেনি। প্রত্যেকটা কর্মসূচী আগেভাগেই সংবাদ সম্মেলন করে বা সভা সমাবেশ করে তার আগাম ঘোষণা দিয়েছে। আগাম ঘোষণা দিয়ে তো কোনোদিন সন্ত্রাসী কান্ড করা যায় না।

॥ তিন ॥
শেখ সেলিম যেটা বলেছেন সেটা তো আরো ভয়ঙ্কর। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় কারা নিয়োজিত সেটা তো সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিলক্ষণ জানেন। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট তাদের দেহরক্ষী নিয়োগের আগে রক্ষীদের অতীত মাইক্রোস্কোপে দেখার মতো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। এমন কথাও তো শোনা যায় যে, তাদের এন্টিসিডেন্ট দেখার সময় ১ নং ক্রাইটেরিয়া থাকে এই যে তারা কি ছাত্রলীগ বা যুবলীগ করেছেন কিনা। এভাবে পরীক্ষা করে ফিল্টারের মতো করে ছেঁকে বা বেছে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। তারপরেও কেন এই আশঙ্কা? শেখ সেলিম বলেছেন তার হাতে নাকি ডকুমেন্ট আছে। সেই ডকুমেন্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সাবমিট করে সন্দেহভাজনদের পাকড়াও করলেই তো হয়।

আরো অনেক কথা আছে। অনেক পয়েন্ট প্রথমে বলেছি। বলেছি যে একদিনে এত সব আলোচনা করা সম্ভব নয়। অতীতে আমি বলেছি যে, ইলেকশন যতই এগিয়ে আসবে ততই এই ধরনের উত্তেজনাকর এবং ভয় সৃষ্টিকারী কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়বে। আমার শেষ কথা হলো এই যে, প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা একটি অতীব স্পর্শকাতর বিষয়। এই ধরনের সেনসিটিভ বা সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে পলিটিক্যাল রেটোরিকের আশ্রয় নেওয়া কারো উচিত নয়। এমনিতেই দেশে যথেষ্ট উত্তেজনা বিরাজ করছে। এতদিন স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তিরা ইউটিউবে সেগুলো আপলোড করতেন। এখন দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশেও অনেক ইউটিউবার এখন অনেক সেনসিটিভ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। আমরা সচেতন ও সতর্কভাবেই সেই সব বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছি। কারণ এতদিন ধরে ডেমোক্লিসের তরবারির মতো ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টের তলোয়ার মাথার ওপর ঝুলছিল। এখন আবার সেটিকে পালিশ করে সাইবার সিকিউরিটি এ্যাক্ট করা হচ্ছে। তাই আমরা সচেতন ভাবেই বিষয়গুলো এড়িয়ে যাই।

কিন্তু যদি বিরোধী দলসমূহ অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার জন্য আব্দুল মোমেন বা শেখ সেলিমরা এসব অপ্রমাণিত অফেনসিভ উক্তি করতে থাকেন তাহলে একটি সময় আসবে যখন প্রতিপক্ষরাও অনেক অপ্রিয় কথা বলবেন। যেমন আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুতে শোক বার্তা দেওয়ার সময় মির্জা ফখরুল এবং রুহুল কবির রিজভি এমন কিছু কথা বলেছেন যা তারা অতীতে ১০/১২ বছর বলেননি।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://www.dailysangram.info/post/533139