সুনামগঞ্জের সব কটি হাওরের বোরো ধান তলিয়ে দিশেহারা হাওরপারের কৃষক। তবু মানুষ শেষ চেষ্টা হিসেবে কাঁচা ধান কেটে ঘরে তুলছেন অন্তত খড়ের কাজটুকু তো চালানো যাবে—এই আশায়। ছবিটি সম্প্রতি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের শনির হাওর থেকে তোলা l প্রথম আলো
২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৯:৩৩

৫০ লাখ হাওরবাসী তীব্র খাদ্যঝুঁকির মুখে

অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ায় হাওরাঞ্চলের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটের ঝুঁকির মুখে। এর মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ তীব্র এবং ৪০ লাখ হাওরবাসী মাঝারি ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে। এক পরিবারে পাঁচজন করে সদস্য হিসাব করলে ১০ লাখ পরিবার বেশি সংকটের মুখোমুখি।
বাংলাদেশ হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্মের (হ্যাপ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সরকারের তরফ থেকে খাদ্যসংকটের কথা স্বীকার করা হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের হিসাবে হাওরের বন্যায় ৪০ লাখ ৩০ হাজার মানুষ (৮ লাখ পরিবার) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ৫ লাখ ৭ হাজার পরিবার বা ২৫ লাখ মানুষ ফসল হারিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে।
কিন্তু ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। অন্যদের জন্য ১৫ টাকা কেজি দরে খোলা বাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) এবং ১০ টাকা কেজি দরে ফেয়ার প্রাইসে চাল বিক্রি করবে মন্ত্রণালয়।
হাওরবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো হাওর এলাকায় যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণ সহায়তা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে।
হাওর সম্মেলনের আহ্বায়ক ও হ্যাপের উপদেষ্টা মোস্তফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো আমাদের নীতিনির্ধারকেরা হাওরের সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। তাঁরা ওএমএস এবং সামান্য কিছু চাল সহায়তা দিয়ে সমস্যার সমাধানের কথা ভাবছেন। হাওরের প্রায় এক কোটি মানুষ যে নিঃস্ব হয়ে গেল, তা ভাবছেন না।’ এই সমস্যাকে রাষ্ট্রের এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য রয়েছে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় যদি আমাদের কাছে আরও খাদ্য চায়, আমরা সরবরাহ করতে পারব। তাদের চাইতে হবে।’
হাওর পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত আন্তমন্ত্রণালয় কমিটির সদস্যসচিব এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মহসীন বলেন, হাওরে কোনো খাদ্যসংকট নেই। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বেশির ভাগেরই অন্য আয় আছে। তারা যাতে কোনো সমস্যায় না পড়ে, সে জন্য সরকার পর্যাপ্ত ত্রাণ নিয়ে তাদের পাশে আছে।
হ্যাপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনির হাওর ও সংলগ্ন এলাকার ফসলডুবির হিসাব ছাড়াই হাওরের ফসলসহ অন্যান্য সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, হাওর এলাকায় মোট ৪ লাখ ১ হাজার ৮৪২ হেক্টর জমিতে ফসল হয়। এর প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। এতে হাওরের ছয় জেলার ৪৭টি উপজেলার ৫ লাখ ৭ হাজার ৩১৮ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে গত বৃহস্পতিবার ক্ষয়ক্ষতির এই হিসাব পাঠানো হয়। এই হিসাব নিয়ে গতকাল শুক্রবার আন্তমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে হাওর এলাকায় মোট ১০ লাখ ২০ হাজার হাঁস, প্রায় ৫২ হাজার মুরগি, ২২ হাজার ৬৪০টি ছাগল, ১ হাজার ৯২টি মহিষ, ১ লাখ ৪০ হাজার ৩২৪টি গরু রয়েছে। এসব গবাদিপশুর সারা বছরের খাবার ঘাস, খড় ও অন্যান্য খাদ্যের বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এ অবস্থায় কৃষকেরা গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।
ব্র্যাকের দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিভাগের পরিচালক নঈম গওহর ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, হাওরের কৃষকেরা ঋণ করে জমি ইজারা নেন। গত বছর ফসলের দাম না পাওয়ায় ঋণের টাকা শোধ করতে পারেননি। এবার ফসল তলিয়ে যাওয়ায় তাঁরা দুই দফার ঋণের ভারে নিমজ্জিত। তাই তাঁদের ঋণ মওকুফ এবং নগদ সহায়তা আরও বাড়ানো উচিত।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1162116/