১৯ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ৮:০০

ঢামেক এলাকায় ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদাবাজি

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) সামনে শতাধিক অবৈধ ভাসমান দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন হলের কয়েকজন নেতা। এই দোকানগুলো থেকে মাসিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক হারে টাকা নিয়ে থাকেন তারা। দোকানদারদের দেয়া তথ্য ও নয়া দিগন্তের হাতে আসা চাঁদা দাবির বেশ কিছু অডিও ও কল রেকর্ড থেকে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ঢামেকের বহির্বিভাগের সামনে থেকে ইমারজেন্সি গেট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে ছোটবড় শতাধিক ভাসমান দোকান আছে। দোকানগুলো থেকে প্রতি মাসে গড়ে তিন-চার লাখ টাকা চাঁদা তোলেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। তারা হলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হল ছাত্রলীগের সহ সভাপতি মেহেদী হাসান সোহেল, শিকদার সাজ্জাদ হোসেন তুষার, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল আলম নয়ন, সাংগঠনিক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম আকাশ, জাহিদ আহমেদ ম্যাক্স (ম্যাক্স ভাই), বুলবুল আহমেদ, সূর্যসেন হলের মুহাইমিনুল ইমনসহ আরো বেশ কয়েকজন। যার মধ্যে সম্প্রতি একই অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সাজ্জাদ তুষার, জাহিদুল অয়ন ও বুলবুল আহমেদকে অব্যাহতি দেয় এবং এরও অনেক আগে মুহাইমিনুল ইমনকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। অব্যাহতি পাওয়া সবাই ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী ও অন্য জড়িতরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী।

তথ্যমতে, বড় দোকানগুলো (যেগুলোতে পণ্যসামগ্রী বেশি) বসাতে এককালীন পাঁচ থেকে ছয় হাজার ও মাসিক সর্বনিম্ন তিন হাজার টাকা করে একেকজন চাঁদা নেন। এ ছাড়াও ডাবের দোকান থেকে গড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার, বড় ভাতের দোকান থেকে সর্বনিম্ন বিশ হাজার, ছোট খিচুড়ি ও ডিমের দোকান থেকে চার থেকে পাঁচ হাজার, চা-বিস্কুট-কলা ইত্যাদির দোকান থেকে তিন হাজার টাকা (ক্ষেত্র বিশেষে কমবেশি) নিয়ে থাকেন। দোকানের আকার অনুপাতে টাকা কমবেশি হয়। এমনকি সামান্য পান-সিগারেটের দোকান বসাতেও তাদের দৈনিক হারে টাকা দিতে হয়। যে দোকান বসায় সেই শুধু চাঁদা নেয়ার কথা থাকলেও অনেক সময় এক দোকান থেকেই একাধিকজন চাঁদা নিয়ে থাকেন। সময়মতো টাকা না দিলে মুহূর্তেই তুলে দেয়া হয় দোকান। দোকান উঠে যাবে এই ভয়ে দোকানদাররা টাকা দিতে বাধ্য হন। শুধু চাঁদা নেয়াই নয়, ছাত্রলীগের এই নেতারা যতক্ষণ সেখানে অবস্থান করেন ততক্ষণ ইচ্ছেমতো খেয়ে টাকা না দিয়েই চলে যান। জানা যায়, সবচেয়ে বেশি দোকান মেহেদী হাসান সোহেলের নিয়ন্ত্রণে। এরপরই মাজহারুল ইসলাম আকাশ ও জাহিদ আহমেদ ম্যাক্সের প্রভাব। শহীদুল্লাহ হল ঢামেক থেকে কাছেই হওয়ায় এসব জায়গায় তাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এ দিকে মুহাইমিনুল ইমন বহিষ্কার হওয়ার পর থেকে একসাথে কাজ করা শাহরিয়া আলম অনন মেডিক্যাল এলাকায় যাওয়া কমিয়েছেন বলে জানা যায়।
নয়া দিগন্তের হাতে থাকা একটি কল রেকর্ডে চাঁদা দাবিকারীকে দোকানদারের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, ‘তোমার কি দোকানদারি করার ইচ্ছে নাই? মাস শেষ হয়ে গেছে, নতুন মাস শুরু হয়েছে তুমি এখনো টাকা দিচ্ছ না কেন? দোকান বন্ধ ছিল তাই টাকা দিতে দেরি হচ্ছে জানালে তিনি বলেন, কোথাও কি দেখছো দোকান ভাড়া দিলে কে দোকান করল নাকি বন্ধ রাখল সেজন্য দোকানের ভাড়া নেয় না? তুমি দোকানদারি করতে চাইলে দ্রুত টাকা দাও নাহলে তোমার দোকানদারি ছুটাবো।’

শহীদুল্লাহ হলের অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মীরা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট চাঁদা তোলা নিয়ে এই দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক পক্ষের দোকানে অন্য পক্ষ চাঁদা চাইলে না দেয়ায় দোকান তুলে দিতে গেলে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতেই উপরোক্ত নেতাদের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। মারামারির ঘটনায় বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি বেলায়েত হোসেন রকিরও জড়িত থাকার কথা জানা যায়। তিনিও তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারী।

ছাত্রলীগের ওই নেতাদের ভয়ে নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক কয়েকজন দোকানদার নয়া দিগন্তকে জানান, সামান্য একটা দোকান এখানে দেই। তার জন্যে যত ধরনের টাকা দেয়া লাগে। তা যার মাধ্যমে দোকান বসাবো তাকে এককালীন ও মাসিক টাকা দেয়া লাগে। যারা দোকান বসায় তারা সবাই ছাত্র। এদের মধ্যে সোহেল ভাই, আকাশ ভাইয়েরা বেশি টাকা নেয়। টাকা না দিতে চাইলেই দোকান তুলে দেয়া ও মারধরের হুমকি দেয়। এসব ছাড়াও একটা বাতি জ্বালালে এটার জন্যে মেডিক্যালের লোকদের প্রতিদিন এক শ’ টাকা দেয়া লাগে। আবার লাইনম্যান (জলিল ও আকরাম নামে দুজন ব্যক্তি) এসে প্রতিদিন টাকা নিয়ে যায়। লাইনম্যান টাকা নিয়ে কাকে দেয় জানতে চাইলে আরেকজন বলেন, পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ আরো সংশ্লিষ্ট যারা আছে তারা তাদের টাকা দেয়। আমরা সেটা সঠিক বলতে পারব না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান সোহেল বলেন, আমি এমন কিছুর সাথে জড়িত না। এমনকি রাজনীতিতেও আমি খুব একটা সক্রিয় না বর্তমান প্রেক্ষাপটে। তবে প্রথম বর্ষ থেকেই ঢাকা মেডিক্যালে যাওয়া হয়, আড্ডা দেয়া হয়। কয়েকজন দোকানদার যাদের আমার এলাকায় বাড়ি। তাদের আমি চিনি। এর বেশি কিছু নয়। মাজহারুল ইসলাম আকাশ বলেন, এই ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের সাথে আমি সম্পৃক্ত না। যদি এটা কেউ অভিযোগ করে থাকে তাহলে সেটা ইনটেনশনালি করেছে। তারা নিজেরা বহিষ্কার হয়েছে যদি অন্য কাউকেও বহিষ্কার করানো যায় এজন্যই এগুলো তারা করছে।

যোগাযোগের চেষ্টা করলে জাহিদ ম্যাক্স ফোন রিসিভ করেননি। তবে শাহরিয়া আলম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি মেডিক্যালের সামনের দোকানের সাথে কোনো কিছুতেই জড়িত না। শহীদুল্লাহ হলের যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত তারাই হয়তো আমার নাম বলেছে অথবা দোকানদারদের দিয়ে বলিয়েছে। আমি রাতের বেলা চা খাইতে গেলে কোনো দিন বাকি খেয়েছি এমনটাও হয়নি। চাঁদাবাজির বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নকে জানালে তিনি বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগ আসলে তদন্ত সাপেক্ষে ঘটনার সত্যতা পেলে আমরা অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/770895