১৯ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ৭:৫০

কারাগারে উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছে না বন্দীরা

কারাগারে উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন না বন্দীরা। এমনকি রাজবন্দীরাও সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি হাসপাতাল থাকলেও সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। হাসপাতালে পর্যাপ্ত সিট নেই। তাৎক্ষণিক জরুরি চিকিৎসা দেয়ার প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থা করা যায় না। বিশেষায়িত হাসপাতালে নেয়ার প্রয়োজন হলেও রয়েছে আ্যাম্বুলেন্স সঙ্কট। অভিযোগ রয়েছে, বন্দীদের কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে শুরুতে গুরুত্ব দেয় না কারাকর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে দিনের পর দিন অসুস্থ অবস্থায় কাটাতে হয় অসুস্থ বন্দীদের। এতে শারিরীক অবস্থা আরও অভনতি হতে থাকে। ফলে সময়মত চিকিৎসা না পেয়ে অনেকে মৃত্যুবরন করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলের বহু নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। অনেকে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বের হয়েছেন। তারা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। বিরোধী পক্ষের কয়েক ডজন শীর্ষ রাজনীতিক এখনো কারাগারে আছেন। কয়েকজনের স্বজনের অভিযোগ- এমন কয়েকজন বন্দী রয়েছেন তারা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বক্ষ ব্যাধি ও হার্টের রোগী এবং বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। গ্রেফতারের আগে তারা নিয়মিত চিকিৎসা সেবা নিতেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করতেন। কারো কারো নিয়মিত ইনহেলার, নেবু লাইজার, নিতে হতো। নিয়মিত হাঁটাচলা করতে হতো। চিকিসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হতো। কিন্তু গ্রেফতারের পর থেকে তাদের চিকিৎসা সেবা বন্ধ রয়েছে। ফলে দিনের পর দিন চিকিসা না পেয়ে তারা আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মুফাসসিরে কুরআন ও সাবেক এমপি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী গত ১৪ আগস্ট ইন্তিকাল করেন। রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলে (বিএসএমএমইউ) তার মৃত্যু হয়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী একজন বিশ্বনন্দিত ইসলামিক বক্তা এবং সফল রাজনীতিবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য। যিনি ১২ জুন ১৯৯৬ থেকে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত একজন সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সংসদীয় দলের উপনেতা হিসেবেও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্দী কাশিমপুর কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসা প্রদানের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ ওঠছে। আল্লামা সাঈদীকে বুকে ব্যাথা অবস্থায় কাশিমপুর কারাগার থেকে শহীদ তাজউদ্দিন আহম্মেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কাশিমপুর কারাগার-১ এর জেলার তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, বুকে ব্যাথা উঠলে তাকে শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ গুরুতর অসুস্থ আল্লামা সাঈদীকে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। এমনকি তার স্বজনদেরকেও বিষয়টি জানায়নি এবং দেখা করতে দেয়া হয়নি। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর হার্টে ৫টি রিং পড়ানো ছিল। এছাড়াও তিনি বার্ধক্য জনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। ২০১০ সাল থেকে কারাগারে ছিলেন তিনি। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পর আল্লামা সাঈদীকে মুক্তি দিয়ে তার পরিবারের তত্ত্বাবধানে মুক্ত পরিবেশে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। কিন্তু কোনো কিছুতেই কান দেয়নি কারা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে বুধবার বিএসএমএমইউয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চিকিৎসায় বিএসএমএমইউয়ের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকেরা সঠিকভাবে তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৩ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় কাশিমপুর কারাকর্তৃপক্ষ দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে। তাকে ভর্তি করে চিকিৎসা কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এরপর ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে সাঈদীর হঠাৎ ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয়। অ্যাডভান্স কার্ডিয়াক লাইফ সাপোর্ট প্রটোকল অনুযায়ী তার চিকিৎসা চলতে থাকে। কিন্তু রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

জানা গেছে, দেশের মোট ৬৮ কারাগারে গড়ে ৮৪ হাজার বন্দী থাকে; যা ধরণ ক্ষমতার চেয়ে প্রায় তিনগুন। বন্দী চাপে কারাকর্তৃপক্ষ অসুস্থদের নিয়িমিত দেখভাল করতে পারে না। এছাড়াও চিকিৎসকের সংখ্যা একেবারেই কম। ভিআইপি বন্দীরা বাইরের হাসপাতালে চিকিৎসা পেলেও সাধারণ কয়েদিদের ভাগ্যে যথাযথ চিকিৎসা জোটে না। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অনেকে কারাগারে আয়েশেও দিন কাটায়। কেউ কেউ সুস্থ থাকা অবস্থায়ও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বাইরের হাসপাতালের কেবিনে থাকারও প্রমাণ মিলেছে। মাসের পর মাস এভাবে সুযোগ সুবিধাও ভোগ করছেন অনেকে। কিন্তু রাজনৈতক মামলায় গ্রেফতারদের ব্যাপারে কারাকর্তৃপক্ষ বরাবরই কঠোর নীতি অবলম্বন করছে বলে অভিযোগ আছে। এমনকি বিনা কারণে ডান্ডাবেড়ি পড়ানোরও নজির রয়েছে। কাউকে কাউকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হাই সিকিউরিটি সেলেও রাখা হয়।

এদিকে কারাগার সূত্রে জানা যায়, গত বছর পর্যন্ত ৮৩ হাজার কারাবন্দীর জন্য চিকিৎসক ছিল ৪ জন। এসময়ে ৬৮ কারাগারে ১৪১ চিকিৎসক পদের ১৩৭টিই খালি থাকার তথ্য পাওয়া যায়। চলতি বছর কারাগারে চিকিৎসক নিয়োগের জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশ দেন। সারাদেশে আট বিভাগে কেন্দ্রীয়, জেলা ও নারী কারাগারে ১৪১টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে ১৩৮ জনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা হাই কোর্টকে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কারা কর্তৃপক্ষ। এক মাসের মধ্যে বাকি তিনটি পদেও চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ওই সময়ের মধ্যেই কারাগারে চিকিৎসক নিয়োগ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের ‘ডাক্তার নিয়োগ বিধিমালা’ চূড়ান্ত করতে বলেছেন হাই কোর্ট। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) জানিয়েছে, কারা হেফাজতে গত মে মাসে দেশে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এপ্রিলে এ সংখ্যা ছিল ১৬। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে সংস্থাটি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী মে মাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানানো হয়। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, ওই মাসে সাত হাজতি ও চার কয়েদির মৃত্যু হয়েছে।

কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছয়জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন নারীসহ দুজন, ময়মনসিংহ কারাগারে একজন নারী, সিরাজগঞ্জ কারাগারে একজন ও রাজবাড়ী কারাগারে একজনের মৃত্যু হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অনেক কয়েদির মৃত্যু হয়। ঘটছে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও। ২০১৯ সালে পঞ্চগড়ে কারা হেফাজতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে আইনজীবী পলাশ কুমার রায়ের মৃত্যু হয়। বিচারিক তদন্তে আত্মহত্যা বলা হলেও তার পরিবার তা মানেনি। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদ মারা যান। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, হৃদরোগে তার মৃত্যু হয়েছে। গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত এক কয়েদি গোলাম মোস্তফার মৃত্যু হয়। শৌচাগারের ভেতরে ভেন্টিলেটরের রডের সঙ্গে পায়জামার ফিতা পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে তদন্তে বলা হয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/533102