১৭ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:১৩

অপরিকল্পিত ড্রেনেজের কবলে ঢাকা

সামান্য বৃষ্টি হলেই আতঙ্কিত হতে হয় রাজধানীবাসীকে। নগরীর বিভিন্ন এলাকার সড়কে দেখা দেয় পানিবদ্ধতা। স্যুয়ারেজ আর বৃষ্টি পানি একাকার হয়ে যায়। এই পানিবদ্ধতার কারণে ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। ফলে কর্মব্যস্ত মানুষের চলাচলে সৃষ্টি হয় অন্তহীন প্রতিবন্ধকতা। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন খেটে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষ। রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ ড্রেনগুলো অপরিকল্পিতভাবে তৈরি করার কারণে বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন এলাকায় নগরবাসীর জন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে একেক সময় একেক কাজের জন্য কাটতে হয় সড়ক। আর এই সড়ক কাটাকাটির জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। ড্রেনগুলো ঠিকমত সচল না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। নগরবাসীকে পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খোলা ড্রেন এবং ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থাপনা করে আসছে। কিন্তু এতেও পুরোপুরিভাবে পানিবদ্ধতা থেকে নগরবাসী রক্ষা না পাওয়ায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।


সরেজমিন দেখা যায়, বৃষ্টির কারণে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আসাদ গেট, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে, কলাবাগন রোর্ড, পুরান ঢাকার বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, খিলগাঁও, গোড়ান, টিকাটুলি, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট যেতে নতুন রাস্তায়, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, মোহাম্মদপুরের কিছু অংশ, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, গুলশান লেকপাড় এলাকার সংযোগ সড়কের কয়েকটি স্থানে বৃষ্টির পানি জমে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ ভবনের দক্ষিণ পাশে পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানিবদ্ধতা দেখা দেয় ধানমন্ডি, মিরপুর ১৩, হাতিরঝিলের কিছু অংশে। বৃষ্টি শুরুর কিছুক্ষণ পরেই ধানমন্ডি, শুকরাবাদের কিছু সড়কে পানি জমে যায়। হাতিরঝিলসহ গুলশান লেকপাড়ের রাস্তায় হাঁটু সমান পানি জমে। পানিবদ্ধতার সময় সড়কে যানবাহনগুলো চলায় সৃষ্টি হচ্ছে ঢেউয়ের, আর সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে ফুটপাথে।

জানা গেছে, এক সময় ঢাকা মহানগরীতে প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে এবং প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স-কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট পানিবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আসছিল। কিন্তু গত ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শাখা-প্রশাখাসহ ৬টি অচল খাল, বর্জ্যে জমাটবদ্ধ ৩টি বক্স কালভার্ট ও প্রায় ২০০ কিমি দৈর্ঘ্যরে নর্দমার মালিকানা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এসব থেকে বর্জ্য অপসারণ, সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত কার্যক্রম শুরু করা হয়। এ সকল খাল, বক্স কালভার্ট ও নর্দমা হতে ২০২১ সালে ৮ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন, ২০২২ সালে ৪ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০২৩ সালে (১৫ জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত) ২ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য ও পলি অপসারণ করা হয়েছে। একসময় সামান্য বৃষ্টির পানিতে নিমগ্ন হয়ে পড়তো নগরীর প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা। পানিবদ্ধতা নিরসনে নিজস্ব অর্থায়নে ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বিগত ৩ বছরে ১৩৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের জন্য চিহ্নিত করা হয়। এগুলোর মধ্যে ১০৩টি স্থানে নর্দমার অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়, বাকী স্থানগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে পানিবদ্ধতা নিরসন কার্যক্রমে নিয়োজিত করা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন শ্যামপুর, মান্ডা, জিরানী ও কালুনগর- এই চার খালের বর্জ্য ও পলি অপসারণ এবং খাল সংস্কার করে নান্দনিক পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৮৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব কাজ বাস্তবায়িত হতে যাওয়া এই চারটি খালের নকশা, অঙ্কন ও জরিপ কাজ বর্তমানে চলমান রয়েছে।

ডিএনসিসি সূত্রে বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় প্রায় গত এক বছরে ১৮৮ দশমিক ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৩ দশমিক ০৪ কি.মি. রাস্তা, ৬৯ দশমিক ৫৬ কি.মি. নর্দমা ও ১৬ দশমিক ১৩ কি.মি. ফুটপাথ নির্মাণ/উন্নয়ন করা হয়েছে। ৭৩৩ দশমিক ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, নর্দমা ফুটপাথ নির্মাণ ও উন্নয়নসহ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প চলমান আছে। প্রকল্পের আওতায় ৭০ দশমিক ২৭ কি.মি. রাস্তা, ১০৩ দশমিক ৫১ কি.মি. নর্দমা, ৫৪ দশমিক ১৭ কি.মি. ফুটপাথ এবং ৪ দশমিক ০৪ কি.মি. মিডিয়ান নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। ৪০২৫ দশমিক ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুনভাবে অর্ন্তভুক্ত ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক অবকাঠামো ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রকল্পটি চলমান আছে। উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬১ দশমিক ৭২ কি.মি. রাস্তা, ২২২ দশমিক ৮২ কি.মি. ড্রেন নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হবে। পানিবদ্ধতা নিরসন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে ডিএনসিসি। পাম্প হাউজের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন ও ক্রয়ের জন্য বাজেটে ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে ডিএনসিসি এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসন সম্ভব হয়েছে। ভারী বৃষ্টি হলেও আগের মতো কোথাও দীর্ঘ সময় পানি জমে না। এটি সম্ভব হয়েছে ওয়াসা থেকে খালগুলো বুঝে পাওয়ার পর সেগুলো অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার ও খনন করে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করায়। পাশাপাশি দ্রুত পানিবদ্ধতা দূর করতে প্রতিটি অঞ্চলে কুইক রেসপন্স টিম কাজ করছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক জিআইএস পদ্ধতিতে খালগুলোর সীমানা নির্ধারণের কাজ চলমান। নতুনভাবে সংযুক্ত ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী ৪০২৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়াও ডিএনসিসির নিজস্ব অর্থায়নে ড্রেনেজ ও রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলমান। নতুন এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসন হবে বলে জানায় ডিএনসিসি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ড.আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীর আশপাশে যে খাল-বিল বা জলাশয় ছিল তাও দিনের পর দিন ভড়াট হয়েছে। নিজস্ব যে জলাশয়গুলো ছিল তাও আমরা ধ্বংস করেছি। ঢাকা শহরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ওয়াটার রিটেনশন এড়িয়া যেটা বৃষ্টির পানি ধারণ করবে। আবার যেসব এলাকায় উন্নয়নকাজ হবে সেখানেও যেন আমাদের অনাচ্ছাদিত এলাকা থাকে, যাতে যেখানে বৃষ্টির পানি পড়বে তা যেন ২০ থেকে ৩০ ভাগ মাটির নিচে চলে যেতে পারে। এই জিনিসটা দরকার ছিল প্লান করে করার কিন্তু সেটা করা হয়নি। এটি নগর পরিকল্পনার বিষয়, সেই সাথে জলাশয়গুলো সংরক্ষণের বিষয়। এদেশের নগর পরিকল্পনা করতে গেলে অবশ্যই পয়ঃনিষ্কাশনের জায়গাগুলোর পরিকল্পনার দরকার ছিল। আমাদের নগর পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে আমাদের ভূপৃষ্ঠের পানি যে নিচের দিকে অর্থাৎ মাটির নিচে যাবে তার কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। আমাদের ড্রেনেজ ব্যবস্থাও পরিকল্পিত না, যার কারণে অল্প বৃষ্টিতেও পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

https://dailyinqilab.com/national/article/595317