১৭ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৭:০৭

আট মাসে ঢামেকে ৩৭৮২ রোগী

ছোট শিশু ইভা। তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। শুক্রবার রাতে ইভার জ্বর আসে। পরীক্ষা করিয়ে ধরা পড়ে ডেঙ্গু। রক্তের প্লাটিলেট একেবারে কম। শিশুটি যন্ত্রণা ও ভয়ে এদিক-সেদিক করছে। ডাক্তার-নার্স দেখলে কেঁদে উঠছে। কখনো কখনো পাশে বসা বোনের দিকে তাকাচ্ছে মলিন মুখে। ইভার বাড়ি শরীয়তপুরে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ২০৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি।

ঢামেকের তথ্যমতে, গত ৮ মাসে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ৩ হাজার ৭৮২ জন। এরমধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী ভর্তি রোগী ৪৯৭ জন।

ইভার বোন জান্নাত বলেন, ছয়দিন ধরে ইভার জ্বর। পরে একটি ফার্মেসি থেকে মেডিসিন এনে খাওয়ানো হয়েছে। এরপরও জ্বর কমেনি। পরের দিন একটি ক্লিনিকে নেয়া হয়। সেখানে পরীক্ষা করিয়ে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তখন ৮০ হাজারে ছিল রক্তের প্লাটিলেট। এরপর শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে ভর্তি করিনি চিকিৎসক বলেছেন রক্ত দেয়া লাগতে পারে আপনারা ঢাকা নিয়ে যান। এর আগে স্থানীয় ক্লিনিকে নেয়ার পরে তিনটা স্যালাইন দেয়া হয়েছিল। তারা বলেছিল স্যালাইন শেষে সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু ওর জ্বর কমে না। এরপর স্যালাইন দেয়া শেষে আবার ক্লিনিকে নেয়ার পরে দেখি ৪৭ হাজারে এসেছে রক্তের প্লাটিলেট। আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে এসেছি। এখন পরীক্ষা করিয়ে দেখি ২৫ হাজারে প্লাটিলেট এসেছে। বোনের রক্ত দেয়া লাগতে পারে। আজ আবার পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে কাল রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে। এত পরীক্ষা করা লাগছে এখন ইনজেকশনের ভয় পাচ্ছে। ডাক্তার-নার্স দেখলেই চিৎকার করে কাঁদছে। অনেকদিন ধরে হাতে ক্যানোলা পরতে পরতে যন্ত্রণা-ব্যথায় কাতরায়। ওর কষ্ট দেখলে আমাদেরই কষ্ট লাগে। সুই দিলে দুই-তিনজন মিলে ধরে রাখতে হয়। চারপাশে বাচ্চারা কান্নাকাটি করে।

শুধু ইভা নয়, বড়দের পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত অনেক শিশু ভর্তি হয়েছে ঢামেকে। হাসপাতালে খালি নেই শয্যা। রোগীর চাপ বাড়ায় সাধারণ ওয়ার্ডে চলছে ডেঙ্গু চিকিৎসা। ওয়ার্ডের ভিতরে-বাইরে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে রোগীদের। রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্স। শিশু ওয়ার্ডগুলোতে বাচ্চারা ছটফট করছে। ডাক্তার ও নার্স দেখলেই ইনজেকশনের ভয়ে-আতঙ্কে কেউ কেউ চিৎকার করছে। গতকাল ঢামেক হাসপাতালে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে ছুটে আসছেন স্বজনেরা। রোগীদের চাপে ঢামেকের অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোতে চাপ বাড়ছে। মেডিসিনের পুরুষ-নারীদের ওয়ার্ডের সবক’টি শয্যা রোগীতে পূর্ণ। নতুন ভবনের ৬ষ্ঠতলার ৬০১, ৬০২ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে পুরুষ এবং অষ্টম তলার ৮০১, ৮০২ মেডিসিন ওয়ার্ডে নারী রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ২০৭, ২০৮ ও ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সেখানেও খালি নেই শয্যা। এখানেও চলছে মেঝেতে রেখে রোগীদের চিকিৎসা। হাসপাতাল জুড়েই যেন রোগী ও স্বজনে ভরা।

ঢামেকের তথ্য অনুয়াযী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ২৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ২১ জন, মে মাসে ১১৪ জন, জুনে ৫৮৫ জন, জুলাই মাসে ১ হাজার ৮৭৫ জন, আগস্টে ১১৩০ জন। গত তিন মাসে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালটিতে। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট ভর্তি রোগী ৩ হাজার ৭৮২ জন। মোট সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ২ হাজার ৫৯৪ জন। শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সী ভর্তি রোগী ছিল ৪৯৭ জন (নারী ২০৩, পুরুষ ২৯৪ জন), ১১ থেকে ২০ বছরের ৮৪৬ জন (নারী ৩০৮, পুরুষ ৫৩৮ জন), ২১ থেকে ৩০ বছরের ১১৫৪ জন (নারী ৪৭৩, পুরুষ ৬৮১ জন), ৩১ থেকে ৪০ বছরের ৬১০ জন (নারী ২৫১, পুরুষ ৩৫৯ জন), ৪১ থেকে ৫০ বছরের ৩২৭ জন (নারী ১৫৭, পুরুষ ১৭০ জন), ৫১ থেকে ৬০ বছরের ১৯৮ জন (নারী ৮৮, পুরুষ ১১০ জন), ৬১ থেকে ৭০ বছরের ৯১ জন (নারী ৪৭, পুরুষ ৪৪ জন), ৭১ থেকে ৮০ বছরের ৩৯ জন (নারী ১৬, পুরুষ ২৩ জন), ৮০ বছরের উপরে ২০ জন (নারী ৬, পুরুষ ১৪ জন)। মোট মৃত্যু ৭১ জনের। এরমধ্যে ৩৩ জন নারী ও ৩৮ জন পুরুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬৬ জন। মোট ভর্তি রোগী ছিল ৩৭৪ জন। ছাড়পত্র পেয়েছে ৪২ জন। মৃত্যু হয়েছে ২ জনের।

২০৭ নম্বর ওয়ার্ডের কর্মরত একজন নার্স বলেন, এই ওয়ার্ডে ১৪ জন ডেঙ্গু রোগী ছিল। অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। এখন ৮ জন ডেঙ্গু রোগী আছে। শয্যা খালি নেই। এক বিছানায় এক-দুইজন করে রোগী থাকছে। অনেকের চিকিৎসা চলছে মেঝেতে। শিশুদের চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বেশির ভাগ সকের বাচ্চা আসে। তাদের ঠিকমতো চিকিৎসা দেয়া যায় না। বাচ্চাতো বাচ্চাই। কারণ তারা তো বোঝে না কিছু বললে। বাচ্চাদের চিকিৎসা দেয়া আসলেই খুব কঠিন। তারা কান্নাকাটি করে, ভয় পায়। কখনো কখনো বাবা-মাও অস্থির হয়ে যায়। যেটা বড়দের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক মানবজমিনকে বলেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি বর্তমানে অপরিবর্তনীয়। কোনো পরিবর্তন নেই। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী একই রকম আসছে। এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু রোগীদের সংখ্যাও কম নয়। সবাইকে ব্যালেন্স করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যে রোগীদের দেখে মনে হচ্ছে একটু সুস্থ তাদের চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠানো হচ্ছে। যাদের অবস্থা একটু খারাপ তাদের ভর্তি নেয়া হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি সবাইকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলতে।

https://mzamin.com/news.php?news=69683