২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৯:৩০

প্রবাসী আয় কমার নেপথ্যে-

অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ হিসেবে খ্যাত রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে নানা উদ্যোগের পরও গতি বাড়ছে না। গত দুই অর্থবছর ধরে দেশে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমছেই। সহসাই এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের কোনো আভাসও দেখা যাচ্ছে না। এমনকি আয় বৃদ্ধির কোনো সুখবরও নেই। চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরে এ খাতে বিপর্যয় আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এছাড়া সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরপর দুই বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রবাসী আয়ের প্রবাহে ধসের প্রবণতা গত তিন দশকে দেখা যায়নি।

প্রবাসী আয় হ্রাসের কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা জানান, রাশিয়ার দুর্বল অর্থনীতি এবং জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েতের মতো উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, পশ্চিমা দেশগুলোতে অভিবাসী-বিরোধী মনোভাব তৈরি হওয়া- এ রকম নানা কারণেই এই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে ধারণা করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, গেল মার্চে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ১০৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। আগের বছরের একই মাসে এসেছিল ১২৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রবাসী আয় এসেছে ৯১৯ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ১ হাজার ১০৫ কোটি ডলার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমেছে ১৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসীরা পাঠান ৯৪ কোটি ডলার। আগের বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল ১১৩ কোটি ডলার। ২০১৬ সালেও প্রবাসীরা ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান। যদিও ২০১৫ সালে এসেছিল ১ হাজার ৫৩২ কোটি ডলার। সে হিসেবে গত বছরে প্রবাসী আয় কমে ১১.১৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৩ সালেও প্রবাসীরা ২.৩৯ শতাংশ কম রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। ওই বছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ৩৮৩ কোটি ডলার পাঠান।
প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে তেলের দাম কমে যাওয়া। এ কারণে এসব দেশের অর্থনীতি শ্লথ যাচ্ছে। তাই ওই সব দেশ প্রবাসী শ্রমিক নিচ্ছে না। আবার অনেক প্রবাসী শ্রমিক ওই সব দেশ থেকে ফিরেও আসছেন। এসব কারণে প্রবাসী আয় কমেছে। এটাকে খুবই দুশ্চিন্তার বিষয় উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, কেননা প্রবাসী আয়ের জন্য আমরা অন্য দেশের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপরই নির্ভর করে থাকি। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর যদি আমাদের নির্ভরতা কমাতে হয়, তবে আমাদের বিকল্প জনশক্তির বাজার খুঁজতে হবে।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারাবাহিক পতনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি কয়েক দফায় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। প্রবাসী আয় কেন কমছে, তা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দল সম্প্রতি সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া গিয়েছিল। তারা দেখেছে, অবৈধ পথে প্রবাসীদের আয় পাঠানোও আগের চেয়ে বেড়েছে। বিকাশের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে প্রবাসীদের থেকে আয় সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে ব্যাংকের চেয়ে বেশি বিনিময় মূল্য পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া প্রবাসী আয় বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রণোদনা দেয়ার পরিকল্পনা চলছে। যারা কম অঙ্কের আয় পাঠাবে, তাদের নগদ প্রণোদনা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, স্বল্পমেয়াদি কোনো উদ্যোগ নিয়ে আয় বাড়ানো যাবে না। বেশি শ্রমিক আছে এমন দেশের দূতাবাসকে সক্রিয় হতে হবে। এছাড়া হুন্ডি ও ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ব্যাংকিং চ্যানেল ও খোলা বাজারে ডলারের দামের পার্থক্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ টাকার বেশি। বেশি টাকার আশায় অনেকেই অবৈধ পথকে বেছে নিচ্ছেন। এদিকে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড, ইউরো, রিঙ্গিত, সিঙ্গাপুর ডলারসহ প্রভৃতি মুদ্রার মূল্যমান কমে গেছে। ফলে এসব দেশের শ্রমিকদের আয়ের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা কম পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর রেমিট্যান্স প্রবাহ সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ৯০৭ কোটি ২৩ লাখ ডলার। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৪৬৫ কোটি ৬৫ লাখ ডলার।
এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছর বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে মাসিক গড় রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ৭৬ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। তিন বছরের ব্যবধানে সেখান থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে তা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮ কোটি ২০ লাখ ডলারে।
এ সময় সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স কমেছে সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে। ২০১২-১৩ অর্থবছর সৌদি আরব থেকে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছিলেন ৩৮২ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমে গত অর্থবছর তা নেমে আসে ২৯৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এসে দাঁড়ায় মাত্র ১৪৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।
দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও রেমিট্যান্স কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত অর্থবছর দেশটি থেকে ২৭১ কোটি ১৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এলেও চলতি অর্থবছরের আট মাসে আমিরাত থেকে এসেছে ১৩২ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। তৃতীয় বৃহৎ শ্রমবাজার যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১০৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছর দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৪২ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=63424