১৭ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৬:৩৯

অব্যাহত কূটনৈতিক চাপে সরকার

ড. আবদুল লতিফ মাসুম

অভ্যন্তরীণ আন্দোলন যতই প্রবল হচ্ছে ততই বাড়ছে বৈদেশিক কূটনৈতিক চাপ। বৈশি^ক নানামুখী চাপ অনুভব করছে আওয়ামী লীগ সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও গ্রেট ব্রিটেন অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন কংগ্রেস সদস্য ঢাকা সফর করে গেছেন।

গত সপ্তাহে এসেছিলেন দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের বৈশি^ক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়কারী। বার্তা সংস্থার খবরে জানা গেছে, এ মাসেই আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের পরিচালক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল এসেছিল তিন সপ্তাহ আগে। বলতে গেলে এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত অনেক কূটনীতিক বাংলাদেশে অনেকবার সফর করেছেন। কূটনীতির ভাষা যাই হোক না কেন, তাদের মূল লক্ষ্য সমাগত জাতীয় নির্বাচন।

পাশ্চাত্যের সরকারগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মৌলিক অধিকার অস্বীকারের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে বেশ আগেই কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। যখনই যেকোনো পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত সরকারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করছেন, তারা ওইসব বিষয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা যেতে না যেতেই ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক দেখা করলেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সাক্ষাতের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথা বললেও বার্তা সংস্থার খবরে স্পষ্ট, যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের তাগিদ দিতেই তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। বৈঠকে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার বলেন, তারা চান, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য হাইকমিশনারকে অবহিত করেছেন, দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাকে দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের গণতন্ত্রবিরোধী ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়টি সামনে আসে। উল্লেখ্য, এসব বিষয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকাল অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির অংশ। এর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় বিষয়টি গুরুত্ব হারায়। তিনি ‘আমেরিকা আমেরিকানদের’ এই স্লোগান তুলে বৈশি^ক সংশ্লিষ্টতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্লিষ্ট করতে চেয়েছেন। জো বাইডেন এসেই বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেন। এ লক্ষ্যে ওয়াশিংটনে বৈশি^ক গণতন্ত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ খাতাপত্রে একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার দেশ হলেও গণতন্ত্র সম্মেলনে দাওয়াত পায়নি। আওয়ামী লীগ সরকার তদবির করেও আমন্ত্রণপত্র জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাইডেন সরকার অনেকবার অনেক প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে গণতন্ত্রায়ন ও মানবাধিকার বিষয়ে সরকারকে তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সরকার ইতিবাচক জবাব না দিয়ে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছে।

জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনে বাংলাদেশ বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অবশেষে প্রস্তাব এসেছে বাংলাদেশকে মানবাধিকার কমিশন থেকে বাদ দেয়ার। পরবর্তীকালে র্যাব ও পুলিশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশকে বিব্রত করে। বাংলাদেশ সরকার লবিস্ট নিয়োগ করেও বিষয়টির সুরাহা করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অব্যাহত হতাশার পর আসে ভিসা নিষেধাজ্ঞা। এবার সরকার নড়েচড়ে বসে। একদিকে তারা যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে অকূটনৈতিক ভাষা ব্যবহার করে, অপরদিকে ভেতরে ভেতরে মার্কিনিদের তুষ্ট করার চেষ্টা করে। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন ভিসানীতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিষয়টি তুঙ্গে পৌঁছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই বলে দেয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়ন তথা সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করা হলো। এরপর বেশ কয়েকটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। কিন্তু কোনো মৌলিক পরিবর্তন যে সূচিত হয়নি তা বোঝা যায় দুই কংগ্রেসম্যানের মন্তব্য থেকে।

গণতন্ত্রায়নের জন্য এর আগে ছয়জন কংগ্রেসম্যান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিনকেনকে চিঠি লিখেন। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসায় বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটছে উল্লেখ করে চিঠিতে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা য্ক্তুরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ও অন্যান্য সংস্থাকে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিতে ধারাবাহিকভাবে আহ্বান জানাতে অনুরোধ করছি, যার মধ্যে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পুলিশের আধা ইউনিট র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব রয়েছে।’ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, মার্কিন কর্মকর্তাদের স্পষ্ট ও পুনঃ পুনঃ বিবৃতি এবং উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকারকে তার মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা মেনে চলা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে। এটি আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতোমধ্যে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে গণগ্রেফতার ও সহিংসতা হয়েছে, যা নির্বাচনের ফলকে কলঙ্কিত করতে পারে এবং সামাজিক সঙ্ঘাতকে আরো গভীর করে তুলতে পারে।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাব ও বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়ে এই কংগ্রেস সদস্যরা লিখেছেন ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও এরপরও বাংলাদেশে দমন-পীড়ন কমেনি।’ এর আগে মার্কিন কংগ্রেসের অপর ছয় সদস্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষ যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন সে সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান। এ ছাড়া এ বছর বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে ১২ জুন ইউরোপীয় পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলকে একটি চিঠি লিখেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য।

অব্যাহত কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে আগামী মাসের প্রথমার্ধে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি-টিকফা সংক্রান্ত পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসবেন মার্কিন বাণিজ্য দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রান্ডন লিঞ্চ। এ ছাড়া অক্টোবরে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সংলাপ আয়োজনের চেষ্টা চলছে। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা বহুমাত্রিক হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশিত বা কাক্সিক্ষত সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে মানবাধিকার ও সুশাসন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, অপ্রচলিত নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। কূটনীতিকরা লক্ষ করছেন, পারস্পরিক সম্পর্কের যেকোনো বিষয় গণতন্ত্রায়ন ও মানবাধিকারের বিষয়টি উল্লেখ করা হচ্ছে। মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাগত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা রয়েছে। ঘোষিত ভিসানীতি যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত উদ্বেগ উৎকণ্ঠারই প্রতিফলন।

কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নির্বাচনের বেশ আগেই এসব তৎপরতা লক্ষ করার কারণ অতীতের নির্বাচনী ঘটনাবলি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ২০১৪ সালে যখন ভোটারবিহীন নির্বাচন হলো অর্থাৎ ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী কূটনীতিকদের আশ^স্ত করেছিলেন, এটি একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। অচিরেই একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কূটনীতিকরা সে কথায় আশ^স্ত হয়ে বিরোধী দলকে আন্দোলন থেকে নিবৃত্ত করেন। পরে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০১৮ সালে একই ঘটনা ঘটে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট যখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপে বসে তখন তিনি বলেছিলেন, আমি জাতির পিতার কন্যা, আমাকে বিশ^াস করুন। বিরোধী নেতৃত্ব তাকে বিশ^াস করেছিল। পরে দেখা গেল, দিনের ভোট রাতে হয়ে গেছে। পাশ্চাত্যের কূটনীতিকরা নিশ্চয় এসব ঘটনা জানেন অথবা তাদের জানানো হয়েছে। সে কারণেই হয়তো নির্বাচনের অনেক আগেই কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যকে আওয়ামী লীগ সরকার আশ^স্ত করার কোনো প্রচেষ্টাই বাকি রাখেনি। সর্বশেষ মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা সমঝোতার উপায় ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকারিতা জানতে চেয়েছে। এ যাবৎ পর্যন্ত মার্কিন বাংলাদেশ আলোচনায় স্পষ্ট, অপরপক্ষ আশ^স্ত হয়নি।

এই কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপে আওয়ামী লীগ সরকার বিব্রত হওয়ার কারণও রয়েছে। বাংলাদেশ চীনের খপ্পরে পড়েছে কি না জানতে চেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানরা। তারা একই সাথে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা ও চলমান বিরোধ নিষ্পত্তিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে সমঝোতার কোনো সুযোগ রয়েছে কি না তাও জানতে চেয়েছেন। কংগ্রেসম্যানদের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ চীনের খপ্পরে পড়েছে কি না তা মার্কিন কংগ্রেসের দুই সদস্য জানতে চেয়েছেন। তাদের কাছে বিভিন্ন লোক বলেছে, বাংলাদেশ একটি ভয়ঙ্কর জায়গা। এরা চীনের খপ্পরে পড়ে গেছে। চীনের গোলাম হয়ে গেছে। এখানে অশান্তি আর অশান্তি। পুলিশ সব লোককে ধরে মেরে ফেলছে। এ ধরনের একটি ধারণায় তাদের ভয় রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসব কোনোটিই সত্য নয়। আমরা চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ছি না। চীন থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ নিয়েছে তা মোট ঋণের মাত্র ১ শতাংশ মাত্র।

এদিকে এত দিন নীরব থাকার পর সরব হয়েছে ভারত। তারা অবশ্য এখন ঠেলায় পড়ে বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি ভারত সফর করেছে। সেখানে তাদের চীনের সাথে সখ্য বৃদ্ধির প্রশ্নে জবাবদিহি করতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভারতীয় নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, চীনের সাথে সম্পর্ক নিছক অর্থনৈতিক, আর তাদের সাথে সম্পর্ক বহুমাত্রিক। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল তাদের বলেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন ইসলামী দল ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে পাকিস্তানের প্রভাব আবার বেড়ে যাবে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

আন্তর্জাতিক কূটনীতি অভিজ্ঞ বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের বন্ধুত্বের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ ভারতের বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। মার্কিন চাপে ভারত বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা মেনে নেবে বলে কূটনীতিকরা মনে করেন।

অপর দিকে, আওয়ামী লীগ সরকার রাশিয়া ও চীনের বন্ধুত্ব ক্রয় করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল বিরোধিতায় পড়েছে। সাধারণত চীন ও রাশিয়া অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে না। মন্তব্য করতে বিরত থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগের পরপর সরকার যখন অসহায়ত্ব বোধ করেছে তখন প্রথমত রুশ দূতাবাস ও পরে চীনা বিবৃতি তদবির করে আদায় করেছে বলে কূটনৈতিক মহলের ধারণা। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে ভারতের সহমত আছে বলে মনে করেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত মন্তব্যে তিনি বলেন, নিকট প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের গুরুত্ব সবাই উপলব্ধি করে। তাই এখানে ভারতের কোনো পক্ষ নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে তিনি মনে করেন না।

বাংলাদেশের সমাগত নির্বাচন নিয়ে অব্যাহত কূটনৈতিক চাপে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু বিব্রতই নয়; তারা চরম হতাশায় ভুগছে। এর প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিন্ম পর্যায়ে কূটনীতিকদের সম্পর্কে তাদের অকূটনৈতিক মন্তব্য। সরকারের সাথে পশ্চিমা কূটনীতিকদের বিব্রতকর আচরণের সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় ইইউসহ বিদেশী মিশনের ১৩ রাষ্ট্রদূতের যৌথ বিবৃতি। ওই বিবৃতির পর নজিরবিহীনভাবে একসাথে ১৩ কূটনীতিককে ডেকে পাঠানো হয়। তাদেরকে এ ধরনের ‘অকূটনৈতিক’ আচরণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এরপরও ওই কূটনৈতিকরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বার্থে তাদের অব্যাহত ভূমিকা রাখার কথা জানিয়েছেন। কোনো কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনীতিকের মন্তব্য ও আচরণকে অনুমোদন করে বিবৃতি দিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের মর্যাদা ও ইমেজ বেড়েছে না কমেছে তা তারাই ভালো বোঝেন। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে কূটনীতিকদের বারবার কথা বলার বিষয়টি মেনে নেয়া কঠিন। কিন্তু আমাদের আচার-আচরণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও অকূটনীতিসুলভ আচরণ যদি আরো কঠিন বিধিনিষেধ আহ্বান করে, অবস্থা আরো অপ্রীতিকর ও বিব্রতকর হওয়াই স্বাভাবিক।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/770329