১৭ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৬:৩৭

ডিম ও সবজির চড়া দাম কারসাজিতে

প্রিয় স্বদেশের উন্নতি দেখলে মনটা আনন্দে ভরে যায়। বাংলাদেশে এখন সারাবছরই রকমারি ফল পাওয়া যায়, পাওয়া যায় নানা স্বাদের মৎস্যও। এটা অবশ্যই উন্নতির দিক। তবে দাম নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। সুস্বাদু আম তো মানুষের রসনা তৃপ্ত করেছে। মওসুমের শেষের দিকে এসে আ¤্রপলির প্রশংসা করতে হয়। আর একটি আম এখন পাওয়া যাচ্ছে, নাম বি-ফোর বা বারি ফোর। দুদিন আগে আমটি কিনেছিলাম কেজি ১০০ টাকা করে। মেহমানের জন্য গতকাল আম কিনতে গিয়ে দেখি সেই একই আমের কেজি ২০০ টাকা। বললাম ব্যাপার কী? এই আমতো আমদানি করা হয়নি। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের তত্ত্বও এখানে চলবে না, তাহলে দামটা এত বড়লো কেন? তরুণ দোকানি হাসতে হাসতে বললো, স্যার সিজন শেষ না, তাই দামটা একটু বেশি। বললাম, কেজি ২০০ টাকা কি একটু বেশি? দোকানি বললো, আপনারে সম্মান কইরা ১০ টাকা কম রাখমু। অতএব সিজন শেষের কারণে ১০০ টাকার বারি ফোর কিনলাম ১৯০ টাকায়। এমন বাস্তবতায় মনে প্রশ্ন জাগলো, আমাদের ব্যবসা অঙ্গনের সততা ও নৈতিকতা প্রসঙ্গে।

সকালে নাতিকে কুরআন পড়াতে আসলেন সম্মানিত হুজুর। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ২০ টাকার ভাজা ডিম আজ খেলাম ২৫ টাকায়। রুটির সাথে এখন আর ভাজি খাই না, শুধু ডিম দিয়েই চালিয়ে যাই। একদিনের ব্যবধানে সেই ডিমের দামও বেড়ে গেল ৫ টাকা। ডিমের দাম এতটা বেড়ে গেল কেন? দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের প্রোটিনের প্রিয় উৎস ডিমের বাজার এতটা অনিয়ন্ত্রিত হলো কেমন করে? পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, মুদ্রিত হচ্ছে প্রতিবেদন। অভিযোগ উঠেছে, বড় বড় কোম্পানি ও ডিলারের কারসাজিতে কৃত্রিম সংকটের কারণে এভাবে ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিমের রাজশাহী পরিস্থিতি নিয়ে ১৫ আগস্টের পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন লক্ষ্য করলাম। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মুরগির ডিম উৎপাদনে রাজশাহী এখন দেশের অন্যতম বৃহৎ অঞ্চল। এখানে প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ ডিম উৎপাদিত হয়। স্থানীয় বাজারসহ ঢাকা ও সারা দেশের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ডিম নেন, যদিও দাম নির্ধারিত হয় ঢাকা থেকে। তবে গত এক সপ্তাহে দেশে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলের দু’টি বড় কোম্পানী ও চারজন ডিলারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, তারা কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করায় ডিমের দাম বেড়েছে। পোলট্রি ফিড বা মুরগির খাদ্যের দাম এবং খামারিদের উৎপাদন খরচ না বাড়লেও রাজশাহীতে ৬-১০ আগস্ট প্রতিদিন খামারি পর্যায়ে ডিমের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে ৬ আগস্ট প্রতিটি সাদা ডিম ৯ টাকা ৭০ পয়সা এবং লাল ডিম ১০ টাকা ৪০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। এরপর প্রতিদিন ডিমের দাম একটু একটু করে বাড়ানো হয়। তাতে ১০ আগস্ট প্রতিটি সাদা ডিমের দাম ওঠে ১০ টাকা ৪০ পয়সা, আর লাল ডিম বিক্রি হয় ১১ টাকা ১০ পয়সায়। ১১ আগস্ট জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজশাহীতে অভিযান চালিয়ে তিনটি দোকানকে ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করে। পরদিন ১২ আগস্ট রাজশাহী শহরের বাইপাস সড়কের মোসলেমের মোড়ের দুই আড়তদারকে মূল্য তালিকা না রাখায় ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ভোক্তা অধিদপ্তর। অভিযানের প্রভাবে ১৩ আগস্ট প্রতিটি সাদা ডিম ১০ টাকা ২০ পয়সা এবং লাল ডিম ১০ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি হয়। উল্লেখ্য যে, দেশে গত তিন মাসে মুরগির খাদ্যের দাম বাড়েনি; বরং মে ও জুনে কমেছে। অথচ ডিমের দাম বেড়েছে দফায় দফায়।

প্রশ্ন জাগে, ডিমের দাম দফায় দফায় কেন বাড়ে, ডিমের মূল্যই বা নির্ধারিত হয় কেমন করে? এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জানা গেছে একটি প্রতিবেদনে। আগের রাতে মুঠোফোনে ডিমের দাম নির্ধারিত করে দেওয়া হয়। পরদিন ওই দামেই বিক্রি হয় ডিম। সরবরাহ প্রতিষ্ঠান থেকে ডিম কেনার পর সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয় খালি রসিদ, যা পরে খুচরা বিক্রেতারা নিজেরাই পূরণ করেন। এভাবেই চট্টগ্রামের ডিমের পাইকারি বাজারে কেনাবেচা চলছে। গত ১৪ আগস্ট সোমবার চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ডিমের আড়তে অভিযানে গিয়ে এমন তথ্যই জানতে পারেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। পাহাড়তলীর আল-আমিন স্টোর নামে একটি পাইকারি দোকানে গিয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দেখতে পান, ক্রয় রসিদে নিজেই দাম লিখছেন বিক্রেতা। তিনি জানান, ডিম সরবরাহের সময় খালি রসিদ পাঠিয়ে দেন সরবরাহকারীরা। রাতে ডিমের দাম মুঠোফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই দাম নিজেরাই বসিয়ে দেন খুচরো বিক্রেতারা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তার জানান, মুঠোফোনে সরবরাহকারী দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তারা রসিদে কোনো মূল্য লেখেনি। তিনি জানান, ক্রয় রসিদে ‘কারসাজির অপরাধে’ আল আমিন স্টোরকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। উপলব্ধি করা যায়, পোলট্রি ফিড বা মুরগির খাদ্যের দাম না বাড়লেও নানা কারসাজির মাধ্যমে বড় বড় কোম্পানী ও ডিলাররা ডিমের দাম বাড়িয়ে চলেছে। তাদের অতি মুনাফালোভী মানসিকতা সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। এমন মানসিকতা আইন ও নৈতিক দৃষ্টিতে নিন্দনীয়।

শুধু ডিম নয়; আলু থেকে বেগুন, শসা থেকে কচুমুখি তথা প্রায় সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে বগুড়ার পাইকারি ও খুচরা বাজারে। ফলে হিমশিম খাচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষ। আমরা জানি, উত্তরাঞ্চলের সবজির অন্যতম বড় পাইকারি মোকাম বগুড়ার মহাস্থান হাট। বাজারে সবজির সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে অথচ দাম চড়া। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মতলুব রহমান বলেন, বৃষ্টিতে সবজির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বাজারে সবজির সরবরাহও স্বাভাবিক রয়েছে। তা সত্ত্বেও বাজারে সবজির ঊর্ধ্বমুখী দাম ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই। কারসাজিতো নৈতিকতার বিপরীত বিষয়। নৈতিক অবক্ষয় এখন সর্বত্র বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/532908