১৬ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৬:১৪

খোঁজা হচ্ছে ৪৮ হাজার কোটি টাকার অর্থায়ন

বিদেশী অর্থায়ন খুঁজছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত

- ৩৪ প্রকল্পে দরকার ৬৫ হাজার কোটি টাকা

উচ্চ অগ্রাধিকার সম্পন্ন, গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অননুমোদিত উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য বিদেশী বিনিয়োগ খুঁজছে সরকার। চলমান প্রকল্প থাকলেও আগামী পাঁচ অর্থবছরের জন্য অর্থাৎ ২০২৮ সাল পর্যন্ত অনুমোদনহীন প্রায় তিন ডজন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন ৬৪ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। যার মধ্যে বিদেশী অর্থায়ন খাতে বরাদ্দ প্রাক্কলন রাখা হয়েছে ৪৮ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। এই সব উন্নয়ন প্রকল্পে এখনো কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি। আশ্বাস পেলে অনুমোদনের জন্য একনেকে প্রস্তাব দেয়া হবে বলে জ্বালানি বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইন প্রায় ২৮ হাজার ৩২০ সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইন প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করা ও প্রয়োজনীয় উপকেন্দ্র নির্মাণ ক্ষমতা বর্ধন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। আর বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করা। বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ সিস্টেম লস ২০১০-১১ অর্থবছরের ১৪.৭৩ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বরে ৯.৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন ৬.২৯ লাখ কিলোমিটার এবং গ্রাহক সংখ্যা ৪.৪৫ কোটি। মুজিববর্ষে দেশের সব নাগরিক ১০০ ভাগ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।

অপর দিকে প্রাকৃতিক গ্যাস দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের প্রায় ৫৯ শতাংশ পূরণ করছে। বর্তমানে মোট আবিষ্কৃত ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৯.৯৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। জানুয়ারি ২০২৩ সময়ে উত্তোলনযোগ্য নিট মজুদের পরিমাণ ৮.৬৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে দেশের জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা প্রায় ১৩.৬৯ লাখ মেট্রিক টন। প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে জ্বালানি উৎসের বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাস ও তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, এলএনজি, ডুয়েল-ফুয়েল, পারমাণবিক ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।

২০৪১ সালের ৬০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্য পূরণে বিনিয়োগ প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের ৭০ শতাংশই সরকারের। তবে আগামীতে বিপুল অর্থের জোগান নিশ্চিতে বিদেশী বিনিয়োগের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। গত দশ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন তিনগুণ বেড়ে সাড়ে ১০ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। আর বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা এখন প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট। ২০৪১ সালে উৎপাদন সক্ষমতা ৬০ হাজার মেগাওয়াটে নিতে চায় সরকার। বিভিন্ন ধরনের শর্তেই বিদেশীদের নিকট থেকে সরকারকে ঋণসহায়তা নিতে হয় এইসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিদেশী সাহায্য পাওয়ার সুবিধার্থে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দবিহীন ৩৪টি নতুন প্রকল্প রাখা হয়েছে। আর এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী তিন থেকে পাঁচ অর্থবছরে ওই নতুন প্রকল্প পর্যায়ক্রমে অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা হবে। এই অর্থের জন্য সরকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে ঋণদানকারী সংস্থা ও দেশকে টার্গেটে রেখেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্র ও এডিপির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছর থেকে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সরকার মোট ৩৪টি প্রকল্প অর্থবছরের এডিপিতে বিদেশী সাহায্য পাওয়ার সুবিধার্থে বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় যুক্ত করেছে। এসবের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট ৯টি প্রকল্প, সঞ্চালনের সাথে একটি প্রকল্প এবং বিতরণের সাথে ১১টি প্রকল্প রয়েছে। এর সবই নতুন প্রকল্প। বিদ্যুৎ উৎপাদন ৯ প্রকল্পে খরচ হবে ১৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। যার মধ্যে বিদেশী অর্থায়ন প্রত্যাশা করা হচ্ছে ১৩ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। বাকিটা সরকার ও সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি, পাওয়ার সেল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি), বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ওজোপাডিকো), ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি), বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের (বিপিএমআই) অধীনে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে। আর জ্বালানি খাতের ১৩ প্রকল্পের জন্য খরচ হবে ১৩ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। যার মধ্যে বিদেশী অর্থায়নের জন্য ধরা হয়েছে আট হাজার কোটি টাকা।

বড় ব্যয়ের প্রকল্পগুলোর মধ্যে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চট্টগ্রাম ও সিলেটে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আধুনিকায়ণ ও ক্ষমতা বর্ধনে ব্যয় হবে ৮ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের পবিবোর বিদ্যুৎব্যবস্থার আধুনিকায়ণ ও ক্ষমতা বর্ধনে। ঢাকার পাশের শিল্প হাব সমৃদ্ধ ১৩টি প্রকল্পের বিতরণ ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ধরা হয়েছে সোয়া ৫ হাজার কোটি টাকা। গজারিয়ায় ৬০০ মেগাওয়াট গ্যাস বা এলএনজিভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে প্রয়োজন সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। তিন হাজার তিন শ’ কোটি টাকার বেশি খরচ হবে ময়মনসিংহে ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাস বা এলএনজিভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে। আড়াই হাজার কোটি টাকা যাবে ওজোপাডিকো এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করার জন্য। আর জ্বালানি খাতের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা যাবে গ্যাস খাতে ইফিসিয়েন্সি উন্নয়ন প্রকল্পে। প্রিপেইড মিটার স্থাপনে ১১ শ’ কোটি টাকার বেশি ধরা হয়েছে। এক হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে স্মার্ট মিটারিংয়ে। ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রিপেইড গ্যাস মিটার স্থাপনে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে।

ইআরডি ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, এবারের অনুমোদিত এডিপিতে চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৪৪ হাজার ৩৯৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যা মোট এডিপির ১৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এর মাঝে বিদেশী অনুদান বা ঋণের প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। সরকার নতুন এডিপিতে বিদ্যুৎ খাতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির সুবিধায় বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত প্রকল্প নিয়েছে ২১টি। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ঋণ পেতে এক্সিম ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), কেএফডব্লিউ, এআইআইবি, ইডিসিএফ, জাইকা, জার্মানি ও এএফডি সাথে যোগাযোগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে বিদেশী অর্থায়ন না পাওয়ার কারণে এডিপিতে থাকা অননুমোদিত অনেক প্রকল্পই গত দুই অর্থবছর ধরে তালিকায় রয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/770164