১৪ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ৬:০৬

ডিমের বাজারে কি হলো?

স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির বড় অংশ পূরণ করে খামারের মুরগির ডিম। সেটির দামও লাফিয়ে বেড়ে অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গতকাল খুচরা বাজারে ডিমের ডজন বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়। এতে বিপাকে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। অন্যদিকে ঢাকায় যখন ডিমের দাম চড়া তখন পাশের দেশ ভারতের কলকাতায় সস্তায় মিলছে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম এই উপাদানটি। কলকাতায় বাংলাদেশি মুদ্রায় একটি ডিম বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৬ টাকা ৮৬ পয়সায় (এক রুপি সমান ১ টাকা ৩২ পয়সা ধরে)। এই হিসেবে কলকাতায় এক ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ৮২ টাকা ৩২ পয়সায়। অর্থাৎ বাংলাদেশে এক ডজন ডিমের দাম কলকাতার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। ঢাকার বাজার ঘুরে এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও ভারতের ডিমের বাজার যাচাইকারী ওয়েবসাইট এগরেট ডট ইন-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে ডজনপ্রতি ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়। সেই হিসাবে এক হালি ডিমের বাজার মূল্য পড়ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।

যা ডিমপ্রতি সর্বোচ্চ ১৫ টাকা। ১০ দিন আগেও খুচরা বাজারে এক হালি ফার্মের ডিম বিক্রি হয়েছিল ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়। এ ছাড়া টিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ঢাকায় প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ১৬৫ থেকে ১৮০ টাকা। সংস্থাটির হিসেবে, এক মাসের ব্যবধানে দেশে ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।

এদিকে ভারতে ডিমের বাজার যাচাইকারী ওয়েবসাইট এগরেট ডট ইন এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের কলকাতায় একটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫ দশমিক ২ রুপিতে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যেটি দাঁড়ায় ৬ টাকা ৮৬ পয়সা (এক রুপি সমান ১ টাকা ৩২ পয়সা ধরে)। এই হিসেবে কলকাতায় এক ডজন ডিমের দাম ৮২ টাকা ৩২ পয়সা। অন্যদিকে ভারতের এই রাজ্যটিতে এক ট্রে অর্থাৎ ৩০টি ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১৫৬ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যেটি দাঁড়ায় ২০৫ টাকা ৯২ পয়সায়। ওয়েবসাইটটির তথ্য অনুযায়ী, ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ডিমের দাম আরও কম। দিল্লিতে একটি ডিমের দাম ৪ দশমিক ৫০ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যেটি দাঁড়ায় ৫ টাকা ৯৪ পয়সা। এই হিসেবে দিল্লিতে এক ডজন ডিমের দাম ৭১ টাকা ২৮ পয়সা। অন্যদিকে এক ট্রে অর্থাৎ ৩০টি ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১৩৫ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যেটি দাঁড়ায় ১৭৮ টাকা ২০ পয়সা।

ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা যা বলছেন: এদিকে ডিমের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামে। আর পোল্ট্রি শিল্প এসোসিয়েশন বলছে, করপোরেট ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ডিমের দাম বাড়াচ্ছে।

তেজগাঁও বাজারের ডিমের পাইকারি বিক্রেতা রবিউল আলম বলেন, বাজারে ডিমের সংকট রয়েছে। এ ছাড়া ডিম পরিবহনের যাতায়াত খরচ বেড়েছে। মুরগির খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অনেক ফার্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর ফলে ডিমের সরবরাহ কমে গেছে। এজন্য ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত থেকে আমদানি করা না হলে ডিমের বাজারে এমন অস্থিরতা থাকবে বলে জানান ডিমের পাইকারি এই বিক্রেতা।

ডিমের দাম বৃদ্ধির জন্য করপোরেট সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার। তিনি বলেছেন, ফিডের দাম বাড়িয়ে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে তাদের দিতে চুক্তি করলে তারা কিছুটা কম দামে ফিড ও মুরগির বাচ্চা দেয়। অন্যথায় বেশি দামে ফিড কিনতে হয়। সময় অসময়ে ডিম ও মুরগির দাম বাড়িয়ে দিয়ে করপোরেট সিন্ডিকেট লাভবান হচ্ছে। মাঝে ভোক্তাদের পকেট ফাঁকা হচ্ছে।

এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেছেন, উৎপাদন কম হওয়ায় দেশে ডিমের দাম বেড়েছে। ডিমের দাম সাড়ে ১২ টাকা হলে সেটি আমাদের কাছে ন্যায্য হয়। ডিমের দাম এর ওপরে হোক এটি আমরাও চাই না। তিনি আরও বলেন, এখন হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে অনেক খামার বন্ধ। যাদের খামারগুলো বড় ছিল তারাও ছোট করে ফেলেছে। তাতে মোট উৎপাদন কমেছে। আমাদের দেশে এখন প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি ডিম দরকার। উৎপাদন হচ্ছে চার কোটি বা ৪ কোটি ২০ লাখ। কখনো-কখনো আরও কম হচ্ছে। এটি একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। এখানে যদি উৎপাদন ১০ লাখ কমে তাহলে কিন্তু ক্রাইসিস (সংকট) হয়ে যায়। আর যদি ১০ লাখ বেশি হয় তাহলেও কিন্তু ওভার প্রোডাকশন হয়ে যায়।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে যা বলা হচ্ছে: ওদিকে ডিমের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণে ডিমের পাইকারি মার্কেটগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অভিযানকালে কয়েকটি দোকানে বিক্রয় রসিদে গরমিল দেখা গেলে জরিমানা আদায় করে সংস্থাটি। ডিমের দাম বাড়ার কারণ জানতে ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, ডিলার ও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যদের সঙ্গে সোমবার (আজ) বৈঠক করা হবে জানিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম সফিকুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, ডিমের মূল্যবৃদ্ধির কারণ এই মুহূর্তে বলতে পারবো না। কাল ব্যবসায়ী ও ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানদের সঙ্গে বৈঠক করার পরই মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে পারবো। তখন আপনাদের কারণ জানাতে পারবো।

এদিকে ডিমের দাম না কমলে প্রয়োজনে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই ডিম আমদানি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইমপোর্ট পারমিশন লাগবে। তাদের সহযোগিতা ছাড়া ডিম আমদানির সুযোগ নেই। আমি আশা করবো শিগগিরই এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গ্রিন সিগন্যাল দিলেই ডিম আমদানির উদ্যোগ নেয়া হবে।

ওদিকে দেশে ডিমের যে উৎপাদন সে অনুযায়ী বাজার ব্যবস্থা বিন্যাস করলে ডিম আমদানির প্রয়োজন হবে না বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেন, একটি ডিমের উৎপাদন মূল্য সাড়ে ১০ টাকার মতো হয়। ফলে একটি ডিমের বিক্রয় মূল্য ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা অতি মুনাফাকে জায়েজ করার জন্য নানা অজুহাত সামনে আনছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব অজুহাতের কোনো বাস্তবতা নাই। এ ছাড়া আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী মহোদয় নিজেই বলেছেন যে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বাজারের অস্থিরতা আরও বাড়বে, এই সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। আগে যারা কারসাজির সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না বলেও জানান তিনি।

https://mzamin.com/news.php?news=69288