১১ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবার, ১২:২১

বন্যার পর চট্টগ্রামের চারদিকে হাহাকার

২৬ জনের মৃত্যু

চট্টগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা এবং নগরের পর এবার দক্ষিণ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও
কক্সবাজারে বুধবার বিকাল থেকেই পানি সরতে শুরু করে। গতকাল বিকাল ৫টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সাতকানিয়ার কয়েকটি গ্রাম ছাড়া কোথাও রাস্তাঘাটে পানি নেই। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়কেও যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণ নিয়ে ছুটে আসছেন অনেকে। আর শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই টানা ৫ দিনের বৃষ্টিতে সৃষ্ট দুর্যোগে পাহাড় ধস, সাপের কামড় ও পানিতে ডুবে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ৭ জন, হাটহাজারীতে ২ জন, কক্সবাজারে ৭ জন ও বান্দরবানে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর পানিতে তলিয়ে যাওয়া ৫ জনের মধ্যে ৪ জনের লাশ পাওয়া গেছে।

এদিকে পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ক্ষতচিহ্ন। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে শত শত ঘরবাড়ি। বাড়িঘরের আসবাবপত্র ভেসে গেলেও যা অবশিষ্ট রয়েছে তার অধিকাংশই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।

বেড়িবাঁধ ভেঙে যেন একাকার। সড়ক ভেঙে তৈরি হয়েছে যত্রতত্র ক্ষতচিহ্ন। কিছু কিছু সড়ক যানবাহন চলাচলেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

লোহাগাড়ার আমিরাবাদের বাসিন্দা সাংবাদিক মাসুম খান মানবজমিনকে বলেন, ‘বুধবার রাত থেকেই পানি নামতে শুরু করেছে। প্রায় সব এলাকার রাস্তাঘাটের পানি সরে গেছে। আশ্রয় ক্যাম্প থেকে মানুষজন ফিরছে। নলকূপগুলোও বন্যার পানিতে অচল হয়ে পড়েছে। ফলে খাবার পানি আর খাদ্যের জন্য হাহাকার চলছে। অধিকাংশ এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ নেই। মোবাইলের টাওয়ার ডুবে যাওয়ায় নেটওয়ার্কও অনেক জায়গায় নেই। অধিকাংশ রাস্তাঘাট যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন খাবার পানি নিয়ে আসছে। তবে এগুলো পর্যাপ্ত নয়। এই এলাকার জন্য তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে বড় ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে এর আগেও জলাবদ্ধতা এবং বন্যা হয়েছিল। তবে এবারের পরিস্থিতি আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বন উজাড়, নির্বিচারে নদী থেকে বালু উত্তোলন ও নালা পরিষ্কার না করার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে দাবি করছেন তারা। বিশেষ করে সাঙ্গু, টংকাবতী ও ডলু নদী থেকে বালু উত্তোলন ও নদী দখল এবং বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বন্যার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

শোয়াইব বিন আলম নামে সাতকানিয়ার এক বাসিন্দা বলেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর উন্নয়নের নামে হরিলুটের কারণে পুরো চট্টগ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। নগরে হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট হওয়ার পরও জলাবদ্ধতা কমার চেয়ে আরও বেড়েছে। অপরদিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামে অপরিকল্পিত রেললাইন নির্মাণ ও খাল সমূহ থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশের কিছু অংশ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম প্লাবিত হওয়ার অন্যতম কারণ।

জানা যায়, এই ভয়াবহ বন্যার জন্য উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনকেই সবচেয়ে বেশি দুষছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি, আগেও নদী ভেঙেছে, টানা বৃষ্টি হয়েছে, পাহাড়ি ঢল এসেছিল। তবে তখন এভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এবার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন তৈরির পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত কালভার্ট নেই রেললাইনে। এ কারণে বন্যার পানি সরতে দেরি হয়েছে। ফলে এমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যদিও বানের স্রোতে রেললাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চরমভাবে। সরে গেছে লাইনে থাকা মাটি ও পাথর।

তবে রেললাইনের কারণে বন্যায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষ- বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক আবুল কালাম চৌধুরী। তিনি বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পটি এডিবি’র অর্থায়নে হয়েছে। যথেষ্ট যাচাই করেই প্রকল্পটি নেয়া হয়েছে, তারপর নির্মাণ দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেললাইনে ২৪৫টি কালভার্ট স্থাপন করা হয়েছে। পানি যাওয়া-আসায় তাই এই রেললাইন কোনো বাধা হচ্ছে না।

এদিকে বৃষ্টি হলেই ডোবে চট্টগ্রাম শহর: চট্টগ্রাম নগরে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এটি যেন নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে টানা ৪ দিনের বৃষ্টিতে গত শুক্রবার থেকে নগরের একটি বড় অংশ তিনদিন পানিতে ডুবেছিল। তবে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় মঙ্গলবার রাত থেকে পানি সরে গেলেও সেই দুর্ভোগ এখনো পোহাচ্ছেন মানুষ। বিশেষ করে শহরের নিচু এলাকায় বসবাসকারীরা যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তা পোষাতে হিমশিম খাচ্ছেন এখনো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে শুরু হওয়া এসব প্রকল্পে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। বড় বড় প্রকল্প নেয়া হলেও বন্দরনগরীর বাসিন্দাদের জল-ভোগান্তি দূর করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এর কারণ হিসেবে সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) পারস্পরিক জেদাজেদি, একে অপরের উপর দোষ চাপানোর কারণে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এমনকি নালা পরিষ্কারের দায়িত্ব কার, সেটা নিয়েও দ্বন্দ্ব রয়েছে এই দুইটি সেবা সংস্থার। মূলত এই নগরের নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এটিই শহরে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সভাপতি মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে পাহাড় থেকে বালি ধুয়ে নালায় পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৫ সালে ড্রেনেজ এবং জলাবদ্ধতার জন্য আলাদা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চট্টগ্রামে যেসব প্রাকৃতিক জলাধার, খাল, নদীনালা এবং পুকুর ছিল আমরা সেগুলো ধ্বংস করেছি। তার চরম প্রতিক্রিয়া আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে পাচ্ছি। এক্ষেত্রে সরকার অনেক চিন্তা করে বিপুল পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে প্রচুর সমন্বয়হীনতা দেখতে পাচ্ছি। যেসব কারণে বন্যা, জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে আর মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছেন।

https://mzamin.com/news.php?news=68855