২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৮:৪০

চাল নিয়ে কারসাজি

হাওরে বন্যার অজুহাতে চালের দাম আরেক দফা বাড়িয়ে দিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে বাজারে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। চালের কোনো ঘাটতি নেই। তার পরও বন্যার কথা বলে চালের সরবরাহ বিঘি্নত হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে দাম বাড়িয়েছেন তারা। রাজধানীর বাজারে গত কয়েকদিনের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি দুই থেকে তিন টাকা। এর আগে মৌসুম শেষের অজুহাত দেখিয়ে গত মার্চ মাসে এক দফা দাম বাড়িয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। এতে এক মাসের ব্যবধানে চালের দাম কেজিপ্রতি গড়ে বাড়ল কমবেশি পাঁচ টাকা।

মৌসুমের শেষ সময় হলেও ব্যবসায়ীদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ চালের মজুদ রয়েছে। সরবরাহেও কোনো সমস্যা নেই। কারণ ব্যবসায়ীরা সে ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছেন। ফলে এখন চালের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলেই মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা। তার পরও অসাধু ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, হাওরে বন্যায় ধান সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। সে কারণে নতুন চাল আসতে দেরি হচ্ছে। ফলে চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে। তবে সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মিলগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বোরো ধান এসেছে। মিলগুলোতে ধান থেকে চাল উৎপাদন করা হচ্ছে।

চালের অতিরিক্ত দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে মিল মালিক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা একে অন্যকে দুষছেন। মিল মালিকরা বলছেন, মৌসুমের শেষভাগে মিলের সব চাল আড়তে দেওয়া হয়েছে। আড়তদাররা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন মিলে নতুন ধান আসছে, চাল উৎপাদন করে সরবরাহ করা হবে। তারা বলেন, সারাদেশে বৃষ্টির কারণে চাতালগুলোও নিয়মিতভাবে ধান প্রক্রিয়াজাত করতে পারেনি। হাওর অঞ্চলে অনেক চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। ধানের দাম বেড়ে যাওয়া ও বন্যার কারণে সরবরাহ বিঘি্নত হওয়ায় দামের ওপর প্রভাব পড়েছে। এদিকে আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, বন্যার কারণে বোরো ধানের চাল সময়মতো বাজারে আসতে পারেনি। মিল মালিকদের কাছে যে চাল রয়েছে, তা মজুদ রাখা হয়েছে। বাজারে কম ছাড়া হচ্ছে। এ কারণে চালের দাম কিছুটা বেড়ে গেছে। তা ছাড়া খুচরা ব্যবসায়ীরাও

বেশি বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। অন্যদিকে, খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, চালের পাইকারি দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।

জানতে চাইলে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বন্যার কারণে মাত্র একটি অঞ্চলের বোরো ধান নষ্ট হয়েছে। সারাদেশে ধানের কোনো ক্ষতি হয়নি। তার মতে, ব্যবসায়ীরা সংকটের খবর পেলেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করেন। এ জন্য চাল সরবরাহে কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধান করা উচিত। হাওর অঞ্চলে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন কম হবে, সেই পরিমাণ চাল হ্রাস করা শুল্কে আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে ব্যবসায়ীরা আর অজুহাত তুলতে পারবেন না।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, মিরপুর শাহ আলী, মগবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েকদিন সরু ও মাঝারি চালের তুলনায় বেশি বেড়েছে মোটা চালের দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে এক বস্তা (৫০ কেজি) মোটা চাল কিনতে গেলে এখন গ্রাহকদের ১৫০ টাকা বেশি দিতে হবে। অন্যদিকে, সরু চাল কিনলে বাড়তি গুনতে হবে বস্তায় ১০০ টাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা গুটি ও স্বর্ণা চাল ৪১ থেকে ৪৩ টাকায় বিক্রি হয়। আগের সপ্তাহে ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। গত মার্চের শুরুতে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা ছিল। এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়েছে। এখন ভালো মানের মাঝারি চাল পাইজাম ও লতা বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকায়, যা আগে ছিল ৪২ থেকে ৪৪ টাকা। বর্তমানে খুচরায় বিআর আটাশ চাল ৪৪ থেকে ৪৬ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। এ চাল আগে ৪১ থেকে ৪২ টাকা ছিল। গতকাল সব ধরনের মিনিকেট ৪৮ থেকে ৫২ টাকা ও ভালো মানের নাজিরশাইল ৫২ থেকে ৫৬ টাকায় বিক্রি হয়, যা আগের সপ্তাহে ছিল যথাক্রমে ৪৬ থেকে ৫০ টাকা ও ৫০ থেকে ৫৬ টাকা। তুলনামূলকভাবে নাজিরশাইল চালের দাম কম বেড়েছে। তবে জিরা নাজির কেজিতে চার টাকা বেড়ে ৪৩ থেকে ৪৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সর্বশেষ বাজারদরের তথ্য অনুযায়ী, সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এক মাসের ব্যবধানে চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৭ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় ৫ থেকে ২৪ শতাংশ বেড়েছে। রাষ্ট্রীয় অন্য সংস্থা কৃষি বিপণন বিভাগের গতকালের তথ্য অনুযায়ী, মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪১ থেকে ৪৩ টাকায় এবং মাঝারি চাল ৪২ থেকে ৪৮ টাকা ও সরু চাল ৫০ থেকে ৫৬ টাকায়। সংস্থাটির গত মাসের বাজারদরের তালিকার সঙ্গে গতকালের তালিকা তুলনা করে দেখা যায়, বর্তমানে সব চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি সেদ্ধ চাল ৩০ থেকে ৩২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ তুলনায় দেশের বাজারে ১১ টাকা বেশি দামে সেদ্ধ মোটা চাল বিক্রি হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বছরে চালের চাহিদা বর্তমানে তিন কোটি টনের ওপরে। হাওরে সব মিলিয়ে বোরো থেকে চাল আসে কমবেশি ছয় লাখ টন। তিন কোটি টনের মধ্যে ছয় লাখ টন তেমন কোনো বড় অঙ্ক নয়। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনো অজুহাত পেলেই বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে অবৈধ মুনাফা করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রশিদ দাবি করেন, মিল মালিকরা চালের দাম বাড়াননি। তিনি অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সমকালকে বলেন, হাওরে বন্যার কারণে যে ধান এখন মিলে আসার কথা, তা আসেনি। একই সময়ে বৃষ্টির কারণে চাতাল বন্ধ থাকায় মিলগুলো বন্ধ ছিল। মৌসুমের এই শেষ সময়ে মিলের চাল আগে থেকেই আড়তে সরবরাহ করা হয়েছে। এখন ৯৯ শতাংশ মিল খালি আছে। সব চাল আড়তগুলোতে আছে। বন্যার কারণে উৎপাদন বিঘি্নত হওয়ায় আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে চাল বিক্রি করছেন। তিনি আরও বলেন, হাওরে বন্যার কারণে এক মাস পর মিলে ধান আসছে। ওই ধান আগে পেলে দাম বাড়ত না। এর পরও বাজারে এখন চালের ঘাটতি নেই। তবে কোনো মিল চাল মজুদ করেনি বলে দাবি করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দিতে সরকার ৩৪ টাকা কেজিতে চাল ও ৯৬০ টাকা মণ ধান কিনবে। এতে বাজারে নতুন ধান হাজার টাকার বেশি দামে কেনাবেচা হচ্ছে। এ ধানের চাল বাজারে এলে ৩৯ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হবে।

আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি জাকির হোসেন রনি সমকালকে বলেন, হাওরে বন্যার কারণে মিল থেকে নতুন চাল আসেনি। এ কারণে বাজারে দাম বেড়েছে। তাছাড়া সরকার যে দামে চাল কেনাকাটা করে, তার চেয়ে বাজারে দাম বেশি থাকে। এবার সরকার ৩৪ টাকা কেজি চাল কেনার ঘোষণা দিয়েছে। গত বছরে এ চাল কিনেছে ২৮ টাকায়। সরকারের বেশি দামে কেনার কারণে বাজারেও বেড়েছে। তিনি দাবি করেন, এখন মিল মালিকরা চাল ধরে রেখেছেন। এ কারণে চালের দাম বাড়ছে। আড়তগুলোতে চাল মজুদের ব্যবস্থা নেই। মিলগুলোতে চালের মজুদ রয়েছে। অল্প কিছু মিল থেকে নতুন চাল আসতে শুরু করেছে। সম্পূর্ণ নতুন চাল আসতে ৭ থেকে ১৫ দিন সময় লাগবে। তিনি বলেন, বন্যার কারণে হাওরের ৬ লাখ টন চাল বাজারে আসেনি। এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ধান উঠেছে। নতুন ধানের এ চাল এলে বাজার স্বাভাবিক হবে। মিল মালিকরা কারসাজি না করলে বাজারে তেমন প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কারওয়ান বাজারের নোয়াখালী রাইস এজেন্সির পাইকারি ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, বন্যার কারণ দেখিয়ে আড়তদাররা বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন। এ কারণে খুচরা বাজারে দাম বেড়েছে। তাছাড়া সরকার ৩৪ টাকা কেজিতে চাল কেনার ঘোষণা দেওয়ার পর আড়ত থেকে বেশি দামে চাল আনতে হচ্ছে।

 

http://bangla.samakal.net/2017/04/29/288877#sthash.R8pVJ6GG.dpuf