১০ আগস্ট ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৪:০০

আমলে নেওয়া হয়নি পূর্বাভাস

ভারী বৃষ্টির কারণে উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বের পার্বত্য এলাকার কিছু স্থানে স্বল্পমেয়াদি বন্যা হতে পারে– ১ আগস্টের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে এমনটাই বলা হয়েছিল। সেই পূর্বাভাসে সুনির্দিষ্ট স্থান, তারিখ ও বৃষ্টির মাত্রা স্পষ্ট করা হয়নি। ৪ আগস্ট থেকেই চট্টগ্রাম বিভাগে শুরু হয় ভারী বৃষ্টি। এর মধ্যেও আবহাওয়া অধিদপ্তর নিয়মিত বুলেটিনে কোন মাত্রায় বৃষ্টি ঝরবে– এর পূর্বাভাস দিতে পারেনি।

তার পরও আবহাওয়া অধিদপ্তর যতটুকু সতর্কবার্তা দিয়েছিল, সেটাও আমলে নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন। ভূমি ধসের শঙ্কার কথা বলা হলেও বিপর্যয় এড়াতে দেখা যায়নি তেমন তৎপরতা, ছিল না প্রচার। বিপর্যয় মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কারও ছিল না আগাম প্রস্তুতি। ফলে বৃষ্টি-বন্যায় তছনছ হয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলা। গতকাল বুধবার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসছে ক্ষতচিহ্ন। বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ভেঙে গেছে মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক, কাঁচা রাস্তা, কালভার্ট। অনেক বেড়িবাঁধ, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে নড়বড়ে। ভেসে গেছে বীজতলা, ফসলের মাঠ, মাছের ঘের। এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্বাভাসের মডেল ও তথ্য-উপাত্ত সুচারুভাবে বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তাদের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষ কষ্ট ও বিপদের মুখে পড়ছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।

বিপর্যয় নতুন নয়, তবু ভাঙছে না ঘুম
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত টানা ১১ দিন ভারী বৃষ্টির রেকর্ড রয়েছে। অতীত রেকর্ডের মধ্যে ২০০৭ সালে ৬১০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছিল। সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ভূমি ধসের কারণে ১২৮ জন মানুষ মারা গিয়েছিলেন। ২০১১ সালে টানা ছয় দিনের ভারী বৃষ্টির কারণে মৃত্যু হয়েছিল ১৯ জনের। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ব্যাপক বৃষ্টির পর ভূমি ধসে ১৬৯ জনের মৃত্যু দেখেছিল বৃহত্তর চট্টগ্রাম। এত প্রাণহানির পরও বড় দুর্যোগের সময় সঠিক পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হচ্ছে আবহাওয়া অধিপ্তর।

আবার যে পদ্ধতিতে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, তা-ও সেকেলে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগেও আধুনিক করা হয়নি ওয়েবসাইট। অফিসিয়াল ফেসবুক পেজও নিয়মিত হালনাগাদ করা হয় না। বৃষ্টি নিয়ে গত এক সপ্তাহে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ফেসবুক পেজে নেই কোনো তথ্য। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও দিতে পারেনি আগাম সতর্কবার্তা। এর আগে বড় ঘূর্ণিঝড়েও পূর্বাভাসে ঘাটতি, তথ্যের গরমিল ও ওয়েবসাইট অচলের বিষয়টি গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল। আগে থেকে সতর্ক না করার কারণে মানুষ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি।

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, আবহাওয়াবিষয়ক প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে হয়। আবহাওয়া বিজ্ঞান বিষয়ে নির্দিষ্ট পুঁথিগত জ্ঞান ছাড়া পূর্বাভাস মডেলের এক থেকে তিন সপ্তাহ আগের তথ্য বিশ্লেষণ করে সতর্কতা জারি করা কঠিন। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের বর্তমান জনবলের কেউই আবহাওয়াবিদ্যায় একাডেমিক ডিগ্রি নেননি। তারা সাধারণ বিষয়ে পড়াশোনা করে কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট তথ্য থাকে না। ফলে পূর্বাভাস স্থানীয় প্রশাসন আমলে নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারে না।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল হাসানও মনে করেন, পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থতার মূল কারণ অধিদপ্তরের বিশ্লেষণ সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। তিনি বলেন, তথ্য তো যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত দেশের আবহাওয়াবিষয়ক ওয়েবসাইটেই পাওয়া যায়; গুগল, ইয়াহুতেও থাকে। তাহলে সঠিক পূর্বাভাস দিতে ভুল হবে কেন? আসলে সঠিক পূর্বাভাসের জন্য শুধু তথ্য হলেই হবে না। এর সঙ্গে প্রয়োজন আগের ৩০ থেকে ৪০ বছরের আবহাওয়ার তথ্যের সঙ্গে বর্তমান আবহাওয়া পরিস্থিতির তুলনা এবং এর সঠিক বিশ্লেষণ।

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক মডেল ব্যবহার করে। তারা পূর্বাভাস দেয় সমুদ্র ও নৌবন্দরগুলোর জন্য। অর্থাৎ তাদের পূর্বাভাস সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এ ছাড়া তাদের দেওয়া সংকেতও ত্রুটিপূর্ণ, যেটি আসলে সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে না। যেমন বলা হয়, বরিশাল বিভাগে বৃষ্টি হবে। তবে বৃষ্টি হয় কোনো একটি বা দুটি জেলায়, সে ক্ষেত্রে অন্য জেলার মানুষ আস্থা হারান।
সমন্বয়হীনতা, প্রস্তুতির ঘাটতি

বৃষ্টি হলেই ডুবে যাচ্ছে বড় বড় শহর। তবে কেন জলাবদ্ধতা হচ্ছে, কী কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হলো– তা নিয়ে আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাঠানো হলেও তা আমলে নেন না তারা। জেলা পর্যায়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কার্যালয় থাকলেও জেলা প্রশাসনের সভাগুলোতে তাদের ডাকা হয় না বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আবহাওয়াবিদ। তিনি বলেন, ভালো নগর তৈরিতে আবহাওয়াবিদ ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। পৃথিবীর সব উন্নত শহরে মানুষ আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনেই জীবন পরিচালনা করেন। অথচ আমাদের দেশে আবহাওয়া পূর্বাভাস সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই গুরুত্ব দেয় না।

এ বিষয়ে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকেই আমরা নিয়মিত মাইকিং করেছি। প্রস্তুতি সভা করেছি। আগে থেকে আমরা প্রস্তুতি না নিলে আরও বড় বিপর্যয় হতে পারত।

আধুনিক যন্ত্র থাকলেও নেই জনবল
নির্ভুল ও আধুনিক উপায়ে পূর্বাভাস দিতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আওতায় ২০১৬ সাল থেকে ২২৫টি স্বয়ংক্রিয় স্টেশনসহ ব্যয়বহুল আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে। তবে প্রশিক্ষিত আবহাওয়াবিদ ও প্রকৌশলীর অভাবে এসব প্রযুক্তি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছে না তারা। প্রতিষ্ঠানটিতে সারাদেশে ১ হাজার ৩৩৮ পদের বিপরীতে আছে ৭০০ জন।

২০৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা খরচায় ঢাকা ও রংপুরে আবহাওয়া-সংক্রান্ত রাডার সিস্টেম স্থাপন করেছে অধিদপ্তর। এর মাধ্যমে কালবৈশাখী, টর্নেডো, অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস সময়মতো দেওয়া যাবে। ২০২২ সালের মার্চে অধিদপ্তরের আবহাওয়া পূর্বাভাসে একটি হাই-ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট টুলকিট সংযুক্ত করা হয়। মূলত বজ্রপাত, বৃষ্টির হার, শিলাবৃষ্টি এবং অন্য আবহাওয়াজনিত বিষয়ের সম্ভাব্য পূর্বাভাস ৫৪ ঘণ্টা আগেই দেওয়ার জন্য এই টুলকিট ডিজাইন করা হয়েছিল। দুঃসংবাদ হলো– রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টুলকিটটি এরই মধ্যে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, জনবলের অভাব পূরণ করা না হলে নতুন যন্ত্রপাতি, এমনকি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশনগুলোও পর্যায়ক্রমে অকার্যকর হয়ে পড়বে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, অটোমেশনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত জনবল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিগুলোকে অন্তত সার্বক্ষণিক সচল রাখার জন্য দক্ষ জনবল থাকতে হবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/2308188802