২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৮:৩৮

ধানের আড়তে ঝুলছে তালা

গভীর পানির ধান আর ঘিয়ের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল ধর্মপাশার মধ্যনগর বাজার। এখন আর ঘিয়ের আড়ত নেই এখানে। আছে ধানের আড়ত। হাওর অঞ্চলের প্রাচীন বাজারগুলোর মধ্যে সাচনা, আজমিরিগঞ্জ, দিরাই, মারকুলী, ভৈরব, বাদাঘাটের পাশাপাশি মধ্যনগর বাজার ধানের জন্য বিখ্যাত। এখানে অর্ধশতাধিক ধানের আড়ত রয়েছে।

প্রতি বছর বৈশাখে হাওরগুলোতে ধানা কাটা শুরু হলে মধ্যনগর বাজারের আড়তগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। স্থানীয় ধান ব্যবসায়ীরা বইয়াখাউরী, টেপী, গচি, রাতা, বাঁশমতি, কালিজিরা, লাল ধান, ছুরাইক্কা, বোরোসহ দেশীয় জাতের ধান সংগ্রহ করে এসব আড়তে মজুদ করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধান সংগ্রহের জন্য সোমেশ্বরী নদীতে সারিবদ্ধভাবে বড় বড় নৌকা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আনন্দের সঙ্গে আড়ত থেকে ধান তোলা হয় নৌকায় এবং ধানের চালান নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন চাতালে।

এবারের চিত্র ভিন্ন। হাওরের প্রায় শতভাগ ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা আড়তে ধান তোলা তো দূরের কথা বছরের খোরাকিই তুলতে পারেননি। ফলে সোমেশ্বরী নদীর পাড় এখন শূন্য। বড় নৌকার ভিড় নেই এখানে। আড়তে আড়তে ঝুলছে তালা। মৌসুমের শুরুতেই ফড়িয়াদের মাধ্যমে ধান সংগ্রহের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তারা। এবার আড়তে এক তোলা ধানও উঠবে না। বিনিয়োগকৃত অর্থ উঠে আসবে কি-না তাও বলা যাচ্ছে না। ফলে আড়তদাররা এখন দিশেহারা। আড়তগুলোর সঙ্গে কৃষক, শ্রমিকসহ হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। ফসলহানির ফলে পুরো হাওর অঞ্চলে খাদ্য-সংকট দেখা দিয়েছে। ধনী-গরিব সবাই এখন সমান। কৃষকরা যেমন ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, তেমনি আড়ত মালিকরাও পড়েছেন বিপাকে।

মধ্যনগর ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি জ্যোতিময় রায় বলেন, 'মধ্যনগর থেকে মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, ভৈরবসহ দেশের

বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাতাল মালিকরা ধান সংগ্রহ করেন। কিন্তু এবার এখানে কেউ আসবেন না। বিষয়টি স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয় অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে।' তিনি আরও বলেন, 'আমি স্থানীয়ভাবে ধান সংগ্রহের জন্য ফড়িয়াদের মাধ্যমে ১০-১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। ফড়িয়ারা স্থানীয় কৃষকদের সেই টাকা দিয়েছে। কৃষকরা সেই টাকা কৃষিকাজে ব্যবহারও করে ফেলেছেন। ফলে সেই টাকা এখন আর উঠে আসার সম্ভাবনা নেই।' হতাশা প্রকাশ করে এই আড়ত মালিক বলেন, 'ব্যবসার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। এখন সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করাও বেশ কষ্টসাধ্য। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি।'

এই মৌসুমে আড়তগুলোতে কাজ করেন স্থানীয় কয়েক হাজার শ্রমিক। কাজ শুরু হওয়ার আগেই চুক্তি অনুযায়ী আড়ত মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে থাকেন তারা। এবার আড়তে কোনো কাজ নেই। যেখানে সংসার চালানোই দায় সেখানে আড়ত মালিকদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি আকাশ-কুসুম চিন্তা ছাড়া কিছুই নয়। নতুন কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়েছেন অনেক শ্রমিক। শ্রমিকদের সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েরাও এলাকা ছাড়ার ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হলেও ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।

আবদুল জলিলের বাড়ি মধ্যনগরের তেলিপাড়া গ্রামে। তিনি এখানকার শ্রমিকদের সভাপতি। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচ। তিনি বলেন, 'আমরার কি অইবো আল্লাই জানে! এইবার আড়দে (আড়ত) কাম (কাজ) করার সুযোগ নাই। আমার সাথে যারা কাম করতো হেরার (তারা) মাইধ্যে অনেকেই এলাকা ছাইড়া গেছেগা। সব গোছাইয়া উঠতা হারলে (পারলে) আমিও যাইয়ামগা।'

মধ্যনগর বাজার বণিক সমিতির সদস্য আলাউদ্দিন বলেন, 'ধানের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা মধ্যনগর বাজার অর্থনীতির এক ছোট্ট অংশ হলেও ধরে রেখেছে আমাদের হাওরের দেশীয় ধান। তবে এবারের ফসলহানির ফলে দেশীয় ধান সংরক্ষণের বিষয়টিও হুমকির মুখে। মধ্যনগরসহ পুরো হাওর অঞ্চলে এখন ধনী-গরিব সবাই সমান।'

১৫ বছর ধরে মধ্যনগর থেকে ধান সংগ্রহ করছেন চাঁদপুর সদরের চাতাল ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক রিপন। তিনি বলেন, 'হাওর অঞ্চলে এবার ফসল তলিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি আমার ব্যবসায় প্রভাব ফেলেছে। দেশের অন্য জায়গা থেকে ধান কিনতে হবে এবার। তবে সে ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ বেশি পড়বে। মধ্যনগর থেকে নৌপথে ধান সংগ্রহ করতে পরিবহন খরচ কম পড়ত। এ ছাড়া দেশের আর কোনো বাজার থেকে এত বিপুল ধানের চালান হয় কি-না সন্দেহ আছে।'

৩৭০টি পরিবারের মধ্যে চাল ও নগদ টাকা বিতরণ :ধর্মপাশা উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে ভিজিএফের আওতায় চাল ও নগদ টাকা বিতরণের উদ্বোধন করা হয়েছে। শুক্রবার বেলা ১১টায় সেলবরষ ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। পরে ওই ইউনিয়নের ৩৭০টি পরিবারের মাঝে প্রত্যেককে ৩৮ কেজি চাল ও নগদ ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মোতালিব খান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুন খন্দকার, উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান মো. মোসাহিদ তালুকদার, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহম্মেদ মুরাদ, সেলবরষ ইউপি চেয়ারম্যান নূর হোসেন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কার্যালয়ের অফিস সহকারী রতন সরকার প্রমুখ।

http://bangla.samakal.net/2017/04/29/288808#sthash.McezAAVd.dpuf