৯ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৯:৪২

বেশি সমালোচিত ছয়টি ধারা এখনো অজামিনযোগ্য

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারায় বেশি মামলা হয়েছে এবং সমালোচিত, এমন ছয়টি ধারা প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে এখনো অজামিনযোগ্য রাখা হয়েছে। খসড়া আইনে কয়েকটি অপরাধের সাজা কমানো হয়েছে। তবে আগের ধারাগুলো বিদ্যমান। অপরাধ ও দণ্ড সংক্রান্ত ২২ ধারার মধ্যে মাত্র একটি বাতিল করা হয়েছে।

অপরাধের তদন্ত ও বিচার সংক্রান্ত ১৬টি ধারার মধ্যে সবই খসড়ায় রয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা দুটি বাতিলের সুপারিশ করেছিল। নতুন আইনে ২১ নম্বর ধারাটি অজামিনযোগ্য রয়ে গেছে।

২১ ধারায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে প্রায় ১৮টি, অভিযুক্ত হয়েছেন ২৪২ জন এবং আটক হয়েছেন ১৯ জন।
তাঁদের পেশাগত বিভাজন করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদরা। এরপর যেসব পেশার লোক এতে অভিযুক্ত হচ্ছেন, তার মধ্যে আছেন আইনজীবী ১১ জন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

সাইবার নিরাপত্তা আইনে ১০ বছর কারাদণ্ডের পরিবর্তে সাত বছর করা হয়েছে। তবে অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান আগের মতোই আছে।

সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৬ পৃষ্ঠার খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধারা আছে ৬২টি। সাইবার নিরাপত্তা আইনে ধারা থাকছে ৬০টি। এর মধ্যে ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
হ্যাকিং হচ্ছে—কম্পিউটার তথ্যভাণ্ডারের কোনো তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তন বা তার মূল্য বা উপযোগিতা কমানো বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতিসাধন বা নিজ মালিকানা বা দখলবিহীন কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে তার ক্ষতিসাধন।

ডিএসএর ৩৩ ধারায় বলা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার বা ডিজিটাল সিস্টেমে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো আর্থিক বা বাণিজ্যিক সংস্থার কোনো তথ্য-উপাত্ত কোনো ধরনের সংযোজন বা বিয়োজন, স্থানান্তর বা স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তা অপরাধ বলে ধরা হবে।
এ ছাড়া সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্মসংক্রান্ত ৫৭ ধারাটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ডিএসএর এই ধারায় বলা হয়েছিল—এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কার্যের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না।

জামিন অযোগ্য ধারা ছয়টি
সাইবার নিরাপত্তা আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২৭, ৩০ ও ৩৩ ধারা এখনো আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য রয়েছে। তবে আগের চেয়ে সাজা কিছুটা কমেছে। আগে জামিন অযোগ্য ধারা ছিল ১৪টি। নতুন আইনে আটটি ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে। আগে ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ ধারা আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য ছিল। ফলে ৬টি ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের সুযোগ বহাল থাকছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেসব ধারায় বেশি মামলা ও বিতর্ক হয়েছে সেগুলো এখনো অজামিনযোগ্য রয়েছে। নতুন আইনে সব ধারা জামিনযোগ্য করা উচিত। কারণ সামান্য কিছু শাস্তি কমিয়ে মানুষের ভোগান্তি কমতে পারে, ব্যাপকতা কমবে না।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকারের কাছে পাঠানো সুপারিশে আইনের যে দুটি ধারা বাতিল এবং আটটি ধারা সংশোধনের কথা বলেছে, সেগুলোর বিষয়ে দেশের নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীরা আগেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাতিলের জন্য বলা ধারা হচ্ছে ২১ ও ২৮। যেগুলো সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা।

এ ছাড়া সম্পাদক পরিষদ ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বিবৃতিও দিয়েছিল, তাতে আইনটির ৯টি ধারার (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) মৌলিক কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছিল। এরপর গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকার, নাগরিকের মত প্রকাশের অধিকার এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা যাঁরাই পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরাই এ নিয়ে বারবার বলেছেন যে সামগ্রিকভাবে এ আইন ও বিশেষভাবে কতিপয় ধারা অগ্রহণযোগ্য এবং তা আন্তর্জাতিক যেসব সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগে হওয়া আইসিটি আইনের একটি ধারা নিয়ে বড় ধরনের আপত্তি ছিল। তখন সরকার বলেছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলে ৫৭ ধারা বাতিল করা হবে। তা-ই করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারার উপাদানগুলো বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। এখন প্রস্তাবিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’-এ সেই ৫৭ ধারার কৌশলই অবলম্বন করা হয় কি না, তা দেখার বিষয়।’

যেসব ধারায় সাজা কমেছে
সাইবার নিরাপত্তা আইনে অপরাধ ও দণ্ড সংক্রান্ত ২১টি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে সাজা কমানো হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭/ক ধারায়, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোয় বেআইনি প্রবেশের শাস্তি সাত বছর থেকে কমে প্রস্তাবিত আইনে তিন বছর হচ্ছে। ১৭/খ ধারার শাস্তি ১৪ বছর থেকে কমে হচ্ছে ছয় বছর।

মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গুবন্ধু, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রপাগান্ডা সংক্রান্ত ২১ ধারা জামিনযোগ্য হচ্ছে, শাস্তি ১০ বছর থেকে কমে

হচ্ছে সাত বছর।
ডিজিটাল জালিয়াতি সংক্রান্ত ২২ ধারাও জামিনযোগ্য হচ্ছে, সাজা পাঁচ বছর থেকে কমে হচ্ছে দুই বছর। ডিজিটাল প্রতারণা সংক্রান্ত ২৩ ধারার সাজা অপরিবর্তিত রেখে এটি জামিনযোগ্য করা হচ্ছে।

পরিচয় প্রতারণা সংক্রান্ত ২৪ ধারাও জামিনযোগ্য হবে, সাজা পাঁচ বছর থেকে কমে হবে তিন বছর। অনুমতি ছাড়া তথ্য সংগ্রহ সংক্রান্ত ২৬ ধারা জামিনযোগ্য হবে, সাজা পাঁচ বছর থেকে কমে হচ্ছে দুই বছর। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত ২৮ ধারাও জামিনযোগ্য হচ্ছে, এই অপরাধের সাজা পাঁচ বছর থেকে কমে হচ্ছে দুই বছর।

মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত ২৯ ধারার কারাদণ্ড বাদ দিয়ে জরিমানা পাঁচ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা সংক্রান্ত ৩১ ধারা হবে জামিনযোগ্য এবং সাজা সাত বছর থেকে কমে হবে পাঁচ বছর।
সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের ৩২ ধারায় সাজা ১৪ বছর থেকে কমে হচ্ছে সাত বছর। এ ছাড়া এটি জামিনযোগ্য হচ্ছে। বেআইনিভাব তথ্য-উপাত্ত ধারণ সংক্রান্ত ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে ‘হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ’ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপিত হবে প্রস্তাবিত আইনে। এই অপরাধের শাস্তি হবে অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা। পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি ও গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ৪৩ ধারা প্রস্তাবিত আইনে অপরিবর্তিত থাকছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/08/09/1306637