৯ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৯:৪০

ডেঙ্গুতে কেন এত প্রাণহানি

ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে, দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ততই অবনতি হচ্ছে। প্রতিদিন যেমন রোগী বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মৃত্যু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগী বাড়লেই মৃত্যু বাড়বে। আর এতে ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে নারী, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, ষাটোর্ধ্ব জনগোষ্ঠী এবং শিশুরা। আর ডেঙ্গুর এই সময়ে সিটি করপোরেশনকে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। ডেঙ্গুতে এত মৃত্যুর কারণ কী? জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। মৃত্যুর আরেকটি কারণ হিসেবে বাংলাদেশের আবহাওয়াকেও দায়ী করেছেন তারা।

বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।

২০২২ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ ছিল। সেই বছরে দেশে সর্বোচ্চ মারা যায় ২৮১ জন। তখন এটাই ছিল সর্বোচ্চ প্রাণহানি। এবছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু খুবই দ্রুত বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪০ জনে। দেশে ইতিমধ্যে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুতে পুরনো রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি চিকিৎসকরাও রেহাই পাচ্ছেন না ডেঙ্গু জ্বর থেকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গতকাল ৩৩ বছর বয়সী এক নারী চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। তার নাম আলমিনা দেওয়ান মিশু। ওই চিকিৎসকের ভাই দেওয়ান জিসান বলেন, আমার বোন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস ফেস-বি কোর্স করছিলেন।

গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৭৪২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত ৩৪০ জনের মধ্যে নারী ১৯৪ জন এবং পুরুষ ১৪৬ জন মারা গেছেন। মোট মৃত্যুর মধ্যে ঢাকার বাইরে মারা গেছেন ৭১ জন এবং রাজধানীতে ২৬৯ জন। মোট শনাক্তের সংখ্যা ৭২ হাজার ২২৫ জন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খাতায় নেই।

ডেঙ্গুতে মৃত্যু কেন বেশি জানতে চাইলে দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এবার ডেঙ্গুতে বেশি মৃত্যুর কারণ মনে হচ্ছে রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। ফলে হাসপাতালে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে। তবে হাসপাতালগুলো মৃত্যুর প্রতিটি কারণ বিশ্লেষণ করলে বৈজ্ঞানিক তথ্য পাওয়া যাবে। এখনো আমরা বৈজ্ঞানিক কোনো তথ্য পাইনি। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালগুলোতে রোগী ব্যবস্থাপনায় তেমন সময় দেয়া হয় না। ফলে গবেষণার ক্ষেত্র খুবই কম। এবছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর আরেকটি কারণ হিসেবে বাংলাদেশের আবহাওয়াকেও দায়ী করেন এই বিশেষজ্ঞ। ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কাজের চেয়ে কথা হচ্ছে বেশি। এজন্যই দিন দিন সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় রোগীরা বেশি ঢাকামুখী হচ্ছেন। তিনি বলেন, করোনার সময় প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ দেয়ার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন দেখছি না। এই জনস্বাস্থ্যবিদ জেলা ও বিভাগে বড় বড় হাসপাতালগুলোকে আরও সক্ষম করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়নসহ বিভিন্ন কারণে এখন সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চলতি বছরে মে মাসের শেষদিক থেকে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সম্প্রতি জানিয়েছে, ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশনের ৫৫টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঢাকার প্রায় সবাই ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার এক থেকে তিন দিনের মধ্যেই প্রায় ৮০ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে। বাকিদের মধ্যে চার থেকে ১০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে ১৪ শতাংশের আর ১১ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে বাকি ৬ শতাংশের। বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলাতেই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। দেশে যে সময়কালকে ডেঙ্গুর মৌসুম বলে ধরা হয়, তার আগেই আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের বেশির ভাগই ঢাকা শহরের বাসিন্দা। শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরীতেই সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে এখন ৫৩টি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই বছরে মৌসুমের আগে আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেহে জ্বর দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। এরপর পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক ওষুধ বা হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন।

ডেঙ্গুতে এবার মৃত্যু বেশি কেন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, আমরা এখন মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করছি। তবে এখন পর্যন্ত থাকা তথ্যের ভিত্তিতে বলতে পারি, প্রায় প্রত্যেকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং তাদের মৃত্যু হচ্ছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। এ ছাড়া অন্য কারণেও হতে পারে। কিন্তু তার জন্য অটোপসি করা প্রয়োজন।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছে- ডেন-১, ২, ৩ ও ৪। এবার এই চার ধরনের মধ্যে একাধিক ডেন থাকলেও চলতি বছরে ডেন দুই এবং তিনের সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। গতবার যেটা ছিল তিন এবং চার। তবে একাধিক সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সিভিয়ারিটি বেশি হয় এবং যত বেশি সিভিয়ারিটি থাকে, তত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়তে থাকে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব অনেক আগেই এসেছে। এটা এখন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। আসলে গত বছরের সঙ্গে এই বছরের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী আসার ক্ষেত্রে কোনো বিরতি ছিল না। শীতকালেও আমরা রোগী পেয়েছি। এবার মৌসুম শুরু হওয়ার এক দেড় মাস আগে থেকেই আমরা অনেক বেশি রোগী পাচ্ছি। ডেঙ্গু মোকাবিলায় যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেটা অনেকটা গতানুগতিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

ডেঙ্গুতে মৃত্যু এত বেশি কেন এবং নারীরা কেন বেশি মৃত্যুবরণ করছেন জানতে চাইলে দেশের খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসছেন। বিশেষ করে নারীরা দেরিতে ট্রিটমেন্ট নেন। নারীরা পরিবারের অন্য সদস্যদের কেয়ার করতে গিয়ে নিজেদের কথা ভুলে যান। কালক্ষেপণ করে হাসপাতালে আসেন। নারীরা বেশি ঘরে থাকছেন। তারা রোদে কম যান। ফলে নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটু কম। এসব কারণে তাদের বেশি মৃত্যু হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে বলেন, ডেঙ্গু জ¦র হলে কালক্ষেপণ না করে দ্রুতই রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এবার হাসপাতালে ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে এক বছরের শিশুরা বেশি ভর্তি হচ্ছে। তাদের রোগ সম্পর্কে চিকিৎসকরা বুঝে ওঠার আগেই মারা যাচ্ছে। মোটা ও বেশি ওজনের শিশুদের দ্রুত শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে। এখন যেসব জটিলতা নিয়ে রোগীরা ভর্তি হয়, তাদের বেশির ভাগই দেরিতে হাসপাতালে আসে। ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে। এমনটা করা যাবে না। জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করানো ভালো।

ডেঙ্গু, ঢামেকে চিকিৎসকসহ ৬ জনের মৃত্যু
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) চিকিৎসকসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু, মোছা. মাইশা আক্তার, মো. নজরুল ইসলাম, মো. আশিক, মোছা. আয়েশা খাতুন ও তাসলিমা আক্তার। এদের মধ্যে চিকিৎসক আলমিনা দেওয়ান মিশু গত সোমবার রাত সোয়া ১টার দিকে মারা যান। তিনি ঢামেকের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউতে) চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোকবার্তায় এসব তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু ময়মনসিংহ মেডিকেলের ৪৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইসিএমএইচ) গাইনি অ্যান্ড অবস বিভাগে রেসিডেন্ট (৩৯ ব্যাচ) হিসেবে অধ্যয়নরত ছিলেন। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন এলাকায়। তার দুই সন্তান রয়েছে।

নিহতের ভাই দেওয়ান জিসান বলেন, আমার বোন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে এমএস ফেস-বি কোর্স করছিলেন। আমার বোনের দুই সন্তান রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক জানান, গত রাত থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নারী চিকিৎসকসহ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=68556