৯ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৯:২৬

অতিবর্ষণ, জোয়ার ও ঢলের পানিতে পরিস্থিতির অবনতি

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী : ৪ জনের মৃত্যু

প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের জলাবদ্ধতা ও বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। কক্সবাজারে পানিতে ডুবে ও সাপের দংশনে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে ৩৫৯ স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। বরকলে পানিতে ডুবে একজন নিখোঁজ রয়েছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফেরিঘাটের পিলার পানির তোড়ে উপড়ে যাওয়ায় বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সাজেকে ৩০০ পর্যটক আটকা পড়েছেন। বর্ষণ ও জলাবদ্ধতার কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এই চার জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ ও আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ দিকে সোমবার রাতে লোহাগড়ায় বানের পানিতে বিজিসি ট্রাস্ট ভার্সিটির ছাত্র জুনাইদুল ইসলাম জারিফ ভেসে গেছে। গতকাল তার লাশ পাওয়া গেছে।

পটিয়া-চন্দনাইশ (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, একটানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া গতকাল দুপুর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ঝুঁকি নিয়ে অল্পবিস্তর যানবাহন চলাচল করতে পারছে।

গত সোমবার রাত ১২টার পরে ভারী বর্ষণের সাথে অস্বাভাবিক জোয়ার ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ উপজেলার কসাইপাড়া এলাকায় মহাসড়কের ওপর দিয়ে ৬ থেকে ৭ ফুট উঁচু ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

মঙ্গলবার দুপুরে সাগরে ভাটা শুরু হওয়ার পর থেকে পানির উচ্চতা কিছুটা কমলে বেলা ২টার পর থেকে ঝুঁকি নিয়ে অল্প বিস্তর যানবাহন চলাচল শুরু করে ওই সড়কে। তবে আজ রাতে পুনরায় জোয়ার আসলে পুনরায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এ দিকে কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ সমগ্র জেলায় অন্তত সাড়ে ছয় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে চট্টগ্রাম জেলায় স্বাভাবিক জীবনযাপন স্থবির হয়ে পড়েছে।

জেলা পুনর্বাসন ও ত্রাণ কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ মজুমদার গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম জেলার ১ লাখ ৪০ হাজার ১২ পরিবারের ৬ লাখ ৩৫ হাজার ১৩০ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৫ টন চাল, জেলার ১৫টি উপজেলায় ৩৩০ টন চাল এবং পটিয়া সাতকানিয়াসহ তিনটি পৌরসভায় ১৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলা।
এই দুই উপজেলাতেই কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গতকাল বিকেলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সরকারি কমিশনার ভূমি জিমরান মোহাম্মদ সায়েক জানিয়েছেন উপজেলায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এ উপজেলায় সোমবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ২০ টন চাল, ৫০ হাজার টাকা শুকনো খাবার স্যালাইন পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা অব্যাহত রয়েছে।
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইদুজ্জামান চৌধুরী জানিয়েছেন উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এ উপজেলায় ২৫ টন চাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

পটিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আতিকুল মামুন জানিয়েছেন উপজেলার প্রায় ৫৩ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এ উপজেলায় ৩০ টন চাল, শুকনা খাবার স্যালাইন ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হচ্ছে বলে গতকাল রাতে জানিয়েছেন ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম ডিভিশন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ সাতকানিয়া উপজেলার ওপর দিয়ে গড়ে ওয়াটার লেভেল থেকে ৬ দশমিক ৮৮ মিটার উঁচু দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

এ দিকে গতকাল সকাল থেকে দোহাজারী বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন গ্রিড অফিসে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় জেলা সাতকানিয়া লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলা সেই সকাল থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে তিন উপজেলার প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এ দিকে গত কয়েক দিনের ভারীবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে হাজার হাজার পুকুরের মাছের প্রজেক্ট তলিয়ে গেছে, এ ছাড়া জেলার রোপণ করা আউশ ধান ও বিস্তীর্ণ আমনের বীজতলা শাকসবজিক্ষেত তলিয়ে রয়েছে।

বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
রাঙ্গুনিয়া-কাপ্তাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, পাহাড়ি ঢল ও কর্ণফুলী নদীর স্রোতে ফেরি বাঁধার দুইটি পিলার উপড়ে যাওয়ায় চন্দ্রঘোনা-রাইখালী ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বান্দরবান-রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় দুইপাড়ের শতশত যানবাহন আটকা পড়ে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।

কক্সবাজার অফিস জানায়, টানা ভারীবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গত সোমবার রাতের পর থেকে আরো নতুন নতুন এলাকায় পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। নদী ও খালের বেড়িবাঁধ ভেঙে ঢলের পানি ঢুকে পড়ছে গ্রামে।

জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, রামু সদর উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের শত শত গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এতে এসব এলাকার তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। মাতামুহুরী নদী ও বাকখালী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাহাড়ি ঢলের তোড়ে মাতামুহুরি নদীর কমপক্ষে ১০টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এসব ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে ঢলের পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মাতামুহুরি নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দারা চরম ভোগান্তিতে রয়েছে বলে জানা গেছে। পেকুয়ায় সাপের দংশনে নেছার আহমেদ নামে একজন রামু উপজেলার রাজারকুলে সামিয়া নামে এক শিশু ঢলের পানিতে ভেসে গিয়ে মারা গেছে। চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বন্যাাকবলিত এলাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। এই দুই উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, তিন দিনের একটানা ভারীবর্ষণে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের সাত হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি-চিংড়িঘেরও। প্রাণহানি রোধে পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে মাইকিং করছে উপজেলা প্রশাসন। তিন দিনের একটানা ভারী বর্ষণের কারণে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হচ্ছে। এরই মধ্যে গত সোমবার উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধসে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন আরো একজন। ৮ এপিবিএনের কমান্ডিং অফিসার মো: আমির জাফর বলেন, সোমবার সাড়ে ৫টার দিকে পানবাজার এলাকার ৯ এর এ/৬ ব্লকের পাহাড়ের পাশে রোহিঙ্গা আনোয়ার ইসলামের শেডের ওপর পাহাড় ধসে পড়ে। এতে আনোয়ার ইসলামের স্ত্রী জান্নাত আরা (২৮) ও তার মেয়ে মাহিম আক্তার (২) নিহত হন। আনোয়ার ইসলামও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

এ দিকে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভী বাজার, ওয়াব্রাং, চৌধুরীপাড়া, রঙ্গিখালী লামারপাড়া, সাবরাং ইউনিয়নের ফতে আলীপাড়া, বাহারছাড়াপাড়া, কুড়া বুইজ্জ্যাপাড়া, মুন্ডার ডেইলপাড়া গ্রামের বসবাসকারী আড়াই হাজার পরিবারের পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি টেকনাফ পৌরসভার ১২টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে ২০ হাজার মানুষ। ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে এসব মানুষের নতুন করে প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ
উখিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা আরো জানান, অতিবৃষ্টি ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে বান্দরবানের লামা, কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়ায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে চন্দনাইশ সড়কে জলাবদ্ধতায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

একটানা তিন দিনের ভারী বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে পার্বত্য বান্দরবানের লামা, কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়ায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে তিন উপজেলার সাড়ে ৫ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দী অবস্থায় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। অন্য দিকে কক্সবাজার সদর উপজেলার সাথে সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। লামা বাজার ৮ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় রান্না করতে না পারায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কটে পড়েছেন এলাকার মানুষ। কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান জানিয়েছেন, সোমবার রাত ৯টা পর্যন্ত গত ২৩ ঘণ্টায় ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টিপাত আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানান তিনি। এ দিকে অসহায় পানিবন্দী মানুষের কাছে ছুটে গেছেন মানবতার সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

ভারী বৃষ্টির পানিতে বান ভেঙে প্লাবিত হওয়া, পেকুয়া উপজেলাধীন, পূর্ব মেহেরনামা এলাকায় পানিবন্দী পরিবারের উদ্ধারকাজে অংশগ্রহণ করে তাদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পেকুয়া উপজেলা শাখার নেতৃবৃন্দ।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/768480