৯ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৯:২০

তত্ত্বাবধায়ক বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক অবস্থানে নেই সরকার

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক অবস্থানে নেই সরকার। যদিও ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় সংবিধানের দোহাই দিয়ে এই ব্যবস্থার গুরুত্ব উপেক্ষা করে যাচ্ছে ১৪ দলীয় জোট সমর্থিত বর্তমান সরকার।

২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। তারা দাবি করে বলেছিলেন, দেশে আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ধারণার প্রবর্তক। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে যা করেছে তা ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলন হয় তার কৃতিত্ব দাবি করে বলা হয়, দেশে আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ধারণার প্রবর্তক। সেসময় সাড়া জাগানো জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জের উইকিলিকস-এর তারবার্তা সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির দায়িত্ব নিতে যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করে। বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গোপন তথ্য ফাঁস করে উইকিলিকস সে সময়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর তথ্য প্রকাশ ছিল অন্যতম। দেশের একটি প্রকাশনা সংস্থার ‘উইকিলিকসে বাংলাদেশ' নামে প্রকাশিত গ্রন্থে এসব তথ্য পরিবেশন করা হয়। গত ১৮ জুলাই ২০০৫ তারিখে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে প্রেরিত এমনই এক কনফিডেনশিয়াল (সি) শ্রেণির তারবার্তা থেকে এই মন্তব্য ও বক্তব্য জানা যায়। ‘সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে বিরোধীদলীয় নেতার অনুরোধ’ শীর্ষক এক তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়, ‘বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা চার্জ দে অ্যাফেয়ার্সকে (সিডিএ) বলেন, “আপনারা যদি চান আমরা নির্বাচনে অংশ নিই, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।” তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিকল্পনা সম্পর্কে চার্জ দে অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জানতে চাইলে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাফর উল্যাহ উৎসাহের সঙ্গে বলেন, ‘আমরা অংশগ্রহণ করতে চাই, কারণ আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেই বেড়ে ওঠা দল, কিন্তু ‘আপনাদের উচিত একটা সমতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) করা।’ নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘আপনারা যদি আমাদের নির্বাচনে দেখতে চান, তাহলে আপনাদের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে।' তাঁরা উল্লেখ করেন, ‘আওয়ামী লীগই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ধারণা প্রবর্তন করেছিল।’ উল্লেখ্য, বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করেছে এবং দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তার অটল অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিরোধীদের দাবি জোরদার হচ্ছে।
নেতাদের সেই বক্তব্য

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে কী ধরনের রাজনীতি হয়েছে আর সেসময় নেতৃবৃন্দ কী বক্তব্য দিয়েছিলেন তা ইতিহাস হয়ে আছে। ১৯৯৫-৯৬ সালে এই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে ৫ আগস্ট ১৯৯৫ আ’লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২ সপ্তাহের সফর শেষে দেশে ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘যদি গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সদিচ্ছা থাকে তাহলে প্রধানমন্ত্রী (খালেদা জিয়া) নির্বাচনের ৯০ দিন আগে পদত্যাগ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর যদি ‘ইল ইনটেনশন’ (বদ মতলব) কিছু না থাকে তবে তিনি আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেবেন। ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পরিষদের এক সভায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রবণতা বন্ধ না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না।’ ৩১ আগস্ট অপর এক সভায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী ৯০ দিন আগে পদত্যাগ করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দাবি- এটা কোন অন্যায় দাবি নয়। ৩ সেপ্টেম্বর ‘৯৫ রাজধানীতে এক জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, (খালেদা) তত্ত্বাবধায়ক বুঝেন না। '৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। বিরোধী দলে থাকতে তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছেন। এখন যদি সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ না হয় তাহলে তো এই সরকার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। ১২ সেপ্টেম্বর ’৯৫ দলের কার্যনির্বাহী পরিষদের এক সভায় দেয়া বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী (খালেদা) তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝেন না। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারও সেদিন তত্ত্বাবধায়ক না বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ’৯৫ শেখ হাসিনা খালেদার সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে তাদের সঙ্গে কোন চুক্তি বা লেনদেন করতে বিদেশী সরকারগুলোর প্রতি আবেদন জানান। বৈদেশিক সংবাদদাতা সমিতির সদস্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এই আবেদন জানান। ১৩ অক্টোবর এক শ্রমিক সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেন, 'সরকার দাবি না মানলে সরকারি দলকে বাদ দিয়ে বিরোধীদলীয়দের নিয়েই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে। সরকারকে আমরা অনেক সুযোগ দিয়েছিলাম। দাবি না মানলে ঐ সুযোগটুকুও দেয়া হবে না। এক সমাবেশে ১৯ অক্টোবর '৯৫ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ক্ষমতায় থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সাথে সাথে মেনে নিতাম।’

অন্যদিকে সাপ্তাহিক বিচিত্রাকে (১০ নবেম্বর ১৯৯৫) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রেখে এদেশে কোন ‘ক্রেডিবল ইলেকশন’ হতে পারে না। জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দেশে কোন নির্বাচন হবে না। এজন্য যতদিন সংগ্রাম দরকার আমরা করব।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সমস্যা সংবিধানিক নয়, রাজনৈতিক- তাই এই সমস্যার সমাধান হতে হবে রাজনৈতিকভাবে। তিন জোটের রূপরেখার মতো একটা ঐকমত্য দাঁড় করালে তা সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে পাস করানো যাবে। যে সংবিধান মার্শাল ল’কে বৈধ করেছে, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি পরিবর্তন করেছে, একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করার জন্য পরিবর্তিত হয়েছে, সেটা এখন দেশের সকল মানুষের ইচ্ছায় বাস্তবায়নে আরেকবার সংশোধন হতে কোন দোষ নেই। তবে ত্রয়োদশ সংশোধনী স্থায়ীভাবে সংবিধানে রাখতে হবে।’

২০০৬-র নৈরাজ্য-তা-ব
বর্তমানে চলমান বিরোধীজোটের আন্দোলন কর্মসূচীর বিরুদ্ধে মহাজোটের পক্ষ থেকে সমালোচনার তুফান উঠলেও তাদের আন্দোলকালে কী ঘটেছিলো তা এক চরম নিষ্ঠুরতার দলিল হয়ে আছে। দলীয় দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অবরোধের নামে মাত্র ৩ দিনের নজরবিহীন ১৪ দলীয় নৈরাজ্য ও তা-বে সারাদেশে অন্তত ৩২টি প্রাণ ঝরে যায়। আহত ও পঙ্গুত্বের শিকার হয় দুই সহ¯্রাধিক মানুষ। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকার। অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর লুটপাটের কারণে সম্পদ বিনষ্ট হয় আরো প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার। সে সময়ের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে এই চিত্র পাওয়া যায়। তিন দিনের সেই অরাজক কর্মসূচি বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ইমেজকে বহির্বিশ্বে করে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০০৬ সালে ২৮, ২৯ ও ৩০ অক্টোবর ১৪ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় তা যে কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে নজিরবিহীন ঘটনা বলে পর্যবেক্ষরা মনে করেন। এ সময়ে সৃষ্ট সংঘাতে সারাদেশে নিহত হয় কমপক্ষে ৩২ জন মানুষ। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ১৫টি জেলায় এসব হত্যা সংঘটিত হয়। এ সময় আহত হয় আরও প্রায় ২ হাজার মানুষ। অনেক আহত মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। এসব ঘটনায় প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হয় আগ্নেয়াস্ত্র, ছোড়া হয় হাতবোমা-পেট্রল বোমা। এছাড়া ব্যবহার করা হয় লাঠি, লগি, বৈঠা, তলোয়ার, রামদা, ছুরি প্রভৃতি। অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট থেকে রেহাই পায়নি পৌরসভা ভবন, সরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক। রাজনৈতিক দলের অফিস, ব্যক্তিগত চেম্বার, বাসগৃহ, দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি বাস, ট্রাক, জীপ, কার, পিক-আপ, টেম্পু ও রিকশা প্রভৃতি। কোন কোন এলাকায় বাড়ি লুটপাট করতে গিয়ে উঠোনের টিউবওয়েল পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। অবরোধের ৩ দিনে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরে দেশজুড়ে যেমন আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়, তেমনি জাতীয় অর্থনীতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকা স্তব্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় সড়ক ও রেলওয়ে বন্ধ থাকায় পণ্য পরিবহণ তথা আমদানি-রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে জাতীয় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। শিল্প মালিকসহ আমদানি-রফতানিকারকদের আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও লাখ লাখ শ্রমিক ও দিনমজুর হয়ে পড়ে কর্মহীন। বাজারে পণ্য সরবরাহ না থাকায় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পায়। পচনশীল জাতীয় কোটি কোটি টাকার পণ্য পচে বিনষ্ট হয়। তিন দিন যাবৎ দেশের কোটি কোটি মানুষকে অস্ত্র ও সন্ত্রাসের মুখে জিম্মি করে রাখা হয়।

https://dailysangram.info/post/532170