৯ আগস্ট ২০২৩, বুধবার, ৯:১৮

তুচ্ছ ঘটনায় হত্যাকাণ্ড বাড়ছে

অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল বিন আমীন

ইসলামপূর্ব আরবের সামাজিক জীবন অনাচার, কুসংস্কার ও নিষ্ঠুরতার যুগকে আইয়্যামে জাহেলিয়া বলা হয়। স্কুলে পড়াকালীন পাঠ্যবইয়ে আরব দেশের অন্ধকার যুগের কথা পড়েছিলাম। ঐ সময় আরবগণ স্বভাব ও চরিত্রের দিক থেকে অজ্ঞতা ও মুর্খতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। কন্যা সন্তানকে আতুর ঘরেই হত্যা করা হতো। সে যুগের অবসান হয়েছে। কিন্তু বর্তমান যামানায় দেশে দেশে অপরাধের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কেউ কেউ নিজের অপরাধ ঢাকতে অপর মানুষকে হত্যা করতে কুন্ঠাবোধ করছে না। বিশ্বের সর্বত্র জুলুম অবিচারের নিষ্ঠুরতায় সাধারণ নিরীহ মানুষ জীবন দিচ্ছে। রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক নিষ্ঠুরতা পুরো সমাজকে গিলে খাচ্ছে। স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, সন্তানের হাতে পিতা-মাতা, পিতা-মাতার হাতে সন্তান, ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই, চাচার হাতে ভাতিজা, ভাতিজার হাতে চাচা, শ্যালকের হাতে দুলাভাই, বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হওয়ার খবর মুদ্রিত হচ্ছে। অথচ আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে বুদ্ধি ও বিবেক দিয়েছেন। কিন্তু কিছু মানুষ খুনের মত জঘন্যতম অপরাধ ও নৃশংস হত্যাকা- করতে কুন্ঠাবোধ করছেন না। প্রতিনিয়ত এসব মর্মান্তিক নিষ্ঠুর ঘটনাগুলো আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে সেই প্রাচীন যুগেও কী মানুষ এমন নিষ্ঠুর ছিল? কিছু মানুষের নিষ্ঠুর আচরণ জঙ্গলের হায়েনার চেয়ে তীব্র হয়ে উঠছে। তাদের নিষ্ঠুরতা পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থির করে তোলছে। ফলে ক্রমাগতভাবে নৃশংসতা জাতীয় বৈশিষ্ট্যতে পরিণত হয়েছে। একটি নিষ্ঠুর ঘটনা আগের ঘটনাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। আমরাও ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।

পৃথিবীর কোন দেশ শতভাগ অপরাধমুক্ত নয়! কম-বেশি সব দেশে অপরাধ আছে; কোথাও কম, কোথাও বেশি। অন্যান্য দেশের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। আমাদের দেশে অপরাধের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিছু মানুষ তুচ্ছ ঘটনায় মানুষ হত্যা করছে। পত্রিকার পাতায় চোখ বুলালেই এরকম খবর চোখে পড়ে। পাঠকেরা নিশ্চয় খাদিজা ও রিফাত কথা ভুলে যায়নি। ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজ রোড এলাকায় প্রকাশ্যে দিনের বেলায় রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও সে সময় ভাইরাল হয়েছিল। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত করার অপরাধে ২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী খাদিজা বেগমকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম। ভাগ্যিস খাদিজা বেঁচে যায়। বর্তমানে দুটো ঘটনারই বিচার চলমান। আশা করি প্রকৃত অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর হবে। ভয়ের সংস্কৃতি ও বিচারহীনতা কোন সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়! সবাই যখন মুখ বুঝে অপরাধ সহ্য করে তখন সেখানে জুলুমের মাত্রা ও অপরাধ বেড়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে খুন কিংবা হত্যা বাড়ছে কেন? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে-ব্যক্তিগত বিরোধ, ব্যক্তিগত স্বার্থ, পারিবারিক কলহ, আর্থিক লেনদেন, রাজনৈতিক বিরোধ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, অসহিষ্ণুতা, অতিরিক্ত ক্ষোভ, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, জমিজমার বিরোধ ইত্যাদি।

জন্মগতভাবে কেউ অপরাধী হয়ে উঠে না। পরিবেশ ও পরিস্থিতি অপরাধী সৃষ্টি করে। পেশাদার অপরাধীরা শুধুমাত্র খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তা কিন্তু নয়! অনেক সময় সাধারণ মানুষ খুন করছে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, একটি সমাজ এমনি এমনি অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে না। সমাজ ও রাষ্ট্রে কেন অপরাধ বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। সবার আগে অপরাধের রুট বন্ধ করা প্রয়োজন। সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা দরকার। সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা না গেলে টেকসই উন্নয়নের আশা করা বোকামি। যে সমাজ ও রাষ্ট্রে সামাজিক ন্যায়বিচার বেশি উন্নত সে সমাজ ও রাষ্ট্র তত বেশি সমৃদ্ধ। এমন বাস্তবতায় আমাদের ন্যায়বিচারের অবস্থা হতাশাজনক। গুম-অপহরণ এর কথা বাদ-ই দিলাম। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যবধি সকল খুনের কথা উল্লেখ করা গেলে বুঝতে সুবিধা হত। কিন্তু সকল খুনের ঘটনা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। নিচে কয়েকটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করলাম- পুলিশ সদর দপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে সারা দেশে তিন হাজার ৫৬৯ জন মানুষ খুন হয়েছেন। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ভাষ্য অনুসারে ২০২১ সালে ঢাকায় ১৬৬টি এবং ২০২০ সালে ২১৯টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। আর এক হিসেব থেকে জানা যায় যে, ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকায় তিন হাজার ৩৭৫টি হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অনুধাবন করে ২০০৭ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব সামাজিক ন্যায়বিচার দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে প্রথম দিবসটি পালিত হয়। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, লিঙ্গ সমতা, অভিবাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, অপরাধ ইত্যাদি বিষয় মোকাবিলার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ দিবসটি পালন করা হয়। অথচ বাংলাদেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ!

আমরা কেউ হত্যাকা- সমর্থন করি না। কিন্তু হত্যাকা- থামছে না কেন? মনে রাখা দরকার। জ্বর কোন রোগ নয়; বরং রোগের উপসর্গ মাত্র। একটি রাষ্ট্রে যখন জনগণের ভোটাধিকার ভূলুন্ঠিত হয়, যেনতেন উপায়ে রাজনৈতিকদলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে সংঘাত সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে, সেখানে কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর জন্ম হয়। তারা অপরাধের জন্ম দেয়। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায় না। কারণ তারা দলের আশ্রয়ে লালিত-পালিত হয়। ফলে থানা পুলিশ সবই তাদের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ থাকে। তারা মানুষরূপী দানবে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক সময় ও অতীতের কিছু ঘটনা নিচে উল্লেখ করলাম- ২৮ জুলাই ২০২৩ নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় শাফলা আক্তার নামে এক নববধূকে পিটিয়ে হত্যার পর লাশে আগুন দেয়ার অভিযোগ শ^শুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে উঠেছে। ২৩ জুলাই ২০২৩ মুন্সীগঞ্জে সিগারেট না দেয়ায় এক কিশোরের হাতে আরেক কিশোর নিহত হয়েছে। ২২ জুলাই ২০২৩ কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ভাইয়ের হাতে বোন নিহত হন। এ ঘটনা উপজেলার শিবপুর গ্রামে ঘটে। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ঢাকার ধামরাইয়ে পরকীয়া দেখে ফেলায় তিন সন্তানকে বটি দিয়ে গলা কেটে হত্যাচেষ্টা করে এক মা। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার মোগলটুলা গ্রামে থুতু ফেলা নিয়ে আপন চাচাতো ভাইয়ের হাতে রোহেল নামে এক যুবক নিহত হন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ এক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে কুপিয়ে এবং গলা কেটে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ফেসবুক লাইভে নিহত স্ত্রীর ছবি দেখিয়েছে। এ ঘটনা শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাড়ায় ঘটেছে। ১৫ এপ্রিল ২০২০ ফেনীতে টুটুল নামের এক যুবক ফেসবুক লাইভে এসে নিজের স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। ১৫ জানুয়ারি ২০২০ কুমিল্লার চান্দিনায় মো. নাছির উদ্দিন নামের এক দোকানদারকে কুপিয়ে হত্যা করার পর তাঁর টুকরা করা লাশ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দেড় কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রাখা হয়। বাইরেও আরো অজস্র ঘটনা আছে যা আমরা জানি না। পত্রপত্রিকার মারফত যতটুকু জানার সুযোগ হয়েছে তার কিছু অংশ উপরে উল্লেখ করলাম মাত্র।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। আমাদের তরুণ-তরুণীরা বিপথগামী হয়ে যাচ্ছে। নেশার মরণ ছোবলে কিছু তরুণ-তরুণীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। একটি পচা আমের সাথে আরেকটি ভালো আম রাখলে পচে যায় তা আমরা বুঝি। একজন নেশাখোর সমাজের আরেকজন নেশাখোর সৃষ্টি করছে তা আমরা বুঝি না। সবাই চাচা আপন জান বাঁচা নীতিতে চলছি। একটি সুস্থ সমাজে যা যা থাকার কথা তার অনেক কিছুই সমাজে অনুপস্থিত। কারণ এখন ঘরে ঘরে সমাজ। কেউ কারও কথা শুনতে চায় না। অথচ একটা সময় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় একজন অভিভাবক থাকতেন, তিনি যা বলতেন পরিবার কিংবা সমাজের সবাই সেটা মেনে নিত। বিয়ে-শাদি থেকে শুরু করে সবকিছুতে মুরুব্বির মতামত গ্রহণ করা হতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। ফলে পারিবারিক বিবাদ-দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বাড়ছে। পুলিশের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, পারিবারিক কলহে গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যার মামলা হয়েছে। প্রতিবছর মোট হত্যাকান্ডের ৪০ ভাগই পারিবারিক কলহ ও তুচ্ছ কারণে সংঘটিত হচ্ছে।

আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে সমাজে অসুস্থ ধারা প্রবল হয়ে উঠছে। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, সততা, পরোপকারিতা ও আদর্শবাদিতার চরম অবক্ষয় পুরো সমাজকে অস্থির করে তুলছে। ভিনদেশীয় সংস্কৃতির জোয়ারে পারবারিক কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারের জায়গায় একক পরিবার গড়ে উঠছে, মানুষের মধ্যে হতাশা ও রাগ বাসা বেঁধেছে। ফলে তুচ্ছ ঘটনায় রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। এ অবস্থার আশু পরির্বতন করা দরকার। বিশেষ করে পারিবারিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি জোর দেয়া দরকার। গ্রামীণ মক্তব চালু করা দরকার। ছোট বয়সে বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর জীবনী, চার খলিফার জীবনী ও সাহাবীদের জীবনী ও বিভিন্ন মনীষীদের জীবনী পড়ানো দরকার। অথনৈতিক বিপ্লবের পাশাপাশি মানুষ গড়ার বিপ্লব করা দরকার। শিশু, কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের স্বস্ব ধর্মীয় শিক্ষার পাঠদানে অভ্যস্ত করা দরকার। সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠা করার জন্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। সর্বোপরি অপরাধের কারণগুলো খুঁজে বের করে সমাধানের পথে হাঁটতে পারলে হত্যা ও খুনাখুনির পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে।

https://dailysangram.info/post/532136