৮ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:৪৬

সাইবার সিকিউরিটি আইনেও ভয়

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) পরিবর্তন করে এর নিবর্তনমূলক বিধিবিধানগুলো রেখে সাইবার সিকিউরিটি আইন করলে জনগণের অস্বস্তি থেকেই যাবে। বিশেষ করে ডিএসএ-তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীদের মতো পেশাজীবীদের ভীতির পরিবেশ দূর হবে না।

এখন পর্যন্ত সাইবার সিকিউরিটি আইন সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যগুলোতে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে, আগের নিবর্তনমূলক ধারাগুলো প্রায় একইভাবে থেকে যাচ্ছে। এটি যেন নতুন মোড়কে ডিএসএ’র রূপান্তর না হয়। এজন্য নতুন নামে চূড়ান্ত করার আগে পূর্বের আইনের ভুক্তভোগী ও অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপকভাবে আলোচনা প্রয়োজন। তাহলে আইনটি অনেক বেশি জনবান্ধব হবে। সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে সাইবার সিকিউরিটি আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদনের পর বিশিষ্টজন ও মানবাধিকারসহ অন্য সংস্থাগুলো এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদনের পর ৯টি ধারা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়। এগুলো হলো-৮, ২১, ২৫, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩। এই ধারাগুলোকে মুক্ত সংবাদমাধ্যমের পরিপন্থি, বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী এবং গণতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধাত্মক হিসাবে উল্লেখ করেন বিশিষ্টজনরা। জামিন অযোগ্য কিছু ধারা ও পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতারসংক্রান্ত ধারাগুলো নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন ওঠে। এ অবস্থায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউরিটি আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়।

সেখানে ডিএসএ’র বিতর্কিত নয়টি ধারায় আমলযোগ্য অপরাধ জামিনযোগ্য করা হচ্ছে। কমানো হচ্ছে সাজার মেয়াদ। তবে পুলিশের পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের ক্ষমতা ঠিকই থাকছে। ফলে ডিএসএ নামে কোনো আইন না থাকার সিদ্ধান্তেও সংশ্লিষ্টদের মনে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এ নিয়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা সতর্ক মন্তব্য করছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন যুগান্তরকে বলেন, যখনই নিরাপত্তা শব্দটি আসে তখনই অনিরাপত্তাবোধের বিষয়টি চলে আসে। এখানে যদি শব্দটা সুরক্ষা থাকত, তাহলে বিষয়টি জনবান্ধব হতে পারত। নামেই একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তাছাড়া সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ যারা এর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে-তারা সবসময় বলেছে, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন।

এই জায়গা থেকে আমরা মুক্তি চাচ্ছিলাম। কিন্তু নতুন আইন প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, সাধারণ মানুষের বক্তব্যগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এই আইন প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কাউকে জিজ্ঞাসাও করেনি; ভুক্তভোগী, বিভিন্ন পেশাজীবী, অংশীজন কারও মতামতও নেওয়া হয়নি। মতামত নিলে নিবর্তনমূলক ধারাগুলো নিয়ে কথা বলা যেত। তাতে মানুষের সুরক্ষার বিষয়গুলো গুরুত্ব পেত।

এই মানবাধিকারকর্মী আরও বলেন, কারও সঙ্গে আলোচনা না করায় নিবর্তনমূলক ধারাগুলো প্রায় একভাবেই থেকে যাচ্ছে। ৪৩ ধারার বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের ধারা কিন্তু ঠিকই রয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারার দণ্ড বিলুপ্ত করে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান নিয়ে তিনি বলেন, এই দণ্ড পরিশোধ করার মতো অবস্থা বাংলাদেশের এক শতাংশ মানুষেরও নেই।

এই অর্থদণ্ড দেওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজের একটা শ্রেণি বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। অর্থাৎ এই আইনটি সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হওয়ার সুযোগ কম। ফলে এটি এক ধরনের বৈষম্যমূলক আইন হবে। সরকারের উচিত এ আইনটি নিয়ে ব্যাপকভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলা। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

তারা এ আইনটি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য ও সুপারিশ করতে পারবেন। এটি স্পষ্ট যে, সমালোচনার কারণে নামটি পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু ভিতরের সব প্রায় একই রকমের রাখা হয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করলে আইনটি অনেক বেশি জনবান্ধব হতে পারত।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের কথা বলছিলাম। সেই অর্থে সাইবার সিকিউরিটি আইনে গুণগত তেমন পরিবর্তন কিন্তু হচ্ছে না। নিপীড়নের চরিত্র আইনের মধ্যে থাকছেই। নাম পরিবর্তন করে একই ধরনের কাজ আগেও করা হয়েছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা পরিবর্তন করে ৭টা সেকশনকে চারটা সেকশনে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।

একইরকমভাবে নাম পালটে সাইবার নিরাপত্তা আইনে যদি বিধিবিধানগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়, তাহলে নাগরিকদের স্বস্তির জায়গা থাকে না। এ ধরনের পরিবর্তনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। নাগরিকরা যেভাবে চাইবে, তাদের প্রয়োজনে সেভাবেই তো আইন হবে। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, সরকার যদি স্বীকারই করে আইন জনগণের মধ্যে ভীতি তৈরি করছে, সেই আইন তো থাকাই উচিত নয়। এজন্য নতুন সাইবার আইন করার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করে নাগরিকদের সঙ্গে আরও আলাপ-আলোচনা করে আইনটি প্রণয়ন করতে হবে।

টিআইবির সতর্ক সাধুবাদ ও আহ্বান : ধারাবাহিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে সতর্ক সাধুবাদ জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তবে সংস্থাটির আহ্বান, ডিএসএ-এর পরিবর্তে নতুন যে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, তা যেন কোনোভাবেই স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ারে পরিণত না হয়। একই সঙ্গে নতুন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করার তাগিদ দিয়েছে টিআইবি।
সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনটি যেন শুধু সাইবার অবকাঠামোর নিরাপত্তায় সীমাবদ্ধ থাকে। এই আইনটি যেন কোনোভাবেই সাইবার অবকাঠামো তথা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে স্বাধীন ও ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা না হয়-তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন যেন ডিএসএ’র প্রতিচ্ছবিতে পরিণত না হয়।

আমরা জানতে পেরেছি ডিএসএ’র বহু ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনে যুক্ত হবে। আমাদের আশঙ্কার জায়গা ঠিক সেখানেই। ডিএসএ’র যেসব ধারা মূলত ভিন্নমত দমন, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে বহুল অপব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত না করার আহ্বান জানাই। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনটি যেন নতুন মোড়কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রূপান্তর হয়ে ফিরে না আসে। অন্যথায়, আইনটির নাম বদল হলেও, কার্যত তা হবে একটি কালাকানুনকে প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন নাম ধারণ করা আরেকটি কালাকানুন মাত্র।

যেন দমনমূলক না হয়-অ্যামনেস্টি : বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটি বলেছে, ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগীরা এই আইনকে ভিন্নমত দমন এবং অনলাইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করতে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছিল।

বাংলাদেশ সরকারকে এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ডিএসএ’র পরিবর্তে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে যেন ডিএসএ’র দমনমূলক বৈশিষ্ট্যগুলো ফিরিয়ে আনা না হয়।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক দপ্তর এক টুইটে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, নতুন আইনটি পাশ হওয়ার আগে সব অংশীজনদের যেন প্রস্তাবিত আইনটি ভালোভাবে দেখা এবং এ নিয়ে মতামত প্রদানের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়।

এর বিধানগুলো যেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এছাড়া মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারচর্চার কারণে যাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তাদেরকে অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে মুক্তি প্রদানের আহ্বান জানায় সংস্থাটি। তাদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার করতেও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আহ্বান জানায়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/704545