৮ আগস্ট ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:৪১

আইনবিদদের অভিমত

নিবর্তনমূলক ধারা থাকছেই

বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তন করে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩’ করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাইবার নিরাপত্তার জন্য যে ধারাগুলো ছিল, সেগুলো নতুন এই আইনে অক্ষুণœ রাখা হয়েছে। সেগুলোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। অপর দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা, যেমন মানহানির যে ধারাটি ছিল, সেই ধারায় আগে শাস্তি ছিল কারাদণ্ড। সেই কারাদণ্ডের জায়গায় এখন জরিমানার বিধান করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন আইনে অনেক ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন।

জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৭ হাজার একটি মামলা দায়ের হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলো চলবে বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন।

অন্য দিকে আইনবিদরা অভিযোগ করেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি এতটাই নিপীড়ন ও নিবর্তনমূলক যে, এটা করাই হয়েছে মানুষকে হয়রানি করার জন্য। আর নতুন আইনে ২৮, ২৯, ৩০, ৩১ ও ৩২ ধারা থাকছেই। তারা বলেন, মানুষের কথা বলা ও মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে ভূলণ্ঠিত করার জন্য নতুনভাবে এ আইন করা হয়েছে। এতে ভুক্তভোগী নাগরিকরা কোনোভাবে উপকৃত হবে না। তাদের মতে, নতুন আইনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাধা দূর করতে হবে। হয়রানিমূলক মামলা করার বিধান বাদ দিতে হবে। যার মানহানি হবে শুধু তিনিই মামলা করতে পারবেন সেই বিধান যুক্ত করতে হবে। একই ঘটনায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা করা যাবে না। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলা গ্রহণ করা যাবে না।

এ বিষয়ে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, মানুষের কথা বলা ও মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে ভূলণ্ঠিত করার জন্য নতুনভাবে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ করা হয়েছে। তিনি বলেন, যেহেতু এই সরকার অনির্বাচিত এবং জনগণের ম্যান্ডেট ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। কাজেই এ সরকারের কোনো কাজে জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হবে না। তিনি বলেন, এই মিথ্যাবাদী সরকারের কাছ থেকে জনগণ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী কারো প্রত্যাশাই এই জঘন্য বা কালো আইন পূরণ করবে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি এতটাই নিপীড়ন ও নিবর্তনমূলক আইন যে, এটা করাই হয়েছে মানুষকে হয়রানি করার জন্য। নতুন আইনে ২৮, ২৯, ৩০, ৩১ ও ৩২ ধারা থাকছেই। তিনি বলেন, এর আগে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বিলোপ করে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এখন নাম পরিবর্তন করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হচ্ছে। ধারা বহাল রেখে নাম পরিবর্তন কেবল পাত্র পরিবর্তন করার মতো। এটা হলে ভুক্তভোগী সাধারণ নাগরিকরা কোনোভাবে উপকৃত হবে না।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোটের আইনজীবী মো: শিশির মনির বলেন, নতুন আইনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাধা দূর করতে হবে। হয়রানিমূলক মামলা করার বিধান বাদ দিতে হবে। তিনি বলেন, যার মানহানি হবে শুধু তিনিই মামলা করতে পারবেন সেই বিধান যুক্ত করতে হবে। একই ঘটনায় বিভিন্ন জায়গায় মামলা করা যাবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় করা মামলা গ্রহণ করা যাবে না। আইনের সংজ্ঞায় অপরাধের বর্ণনা সুনির্দিষ্টভাবে থাকতে হবে।

সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ এর বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু অপব্যবহার কিংবা মিসইউজ রোধ করতে আমরা নাম পরিবর্তন করেছি। যেমন, আগে মানহানিতে কারাদণ্ড ছিল, সেখানে এখন কারাদণ্ড নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলে একটা মানসিক চাপ থেকে যায়। স্বাধীন সংবাদ পরিবেশনে একটি মানসিক চাপ থাকে। সেটিকেও আমরা কর্তব্যের মধ্যে নিয়েছি। এ কারণে আমরা পরিবর্তন করেছি। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রহিতকরণ ও হেফাজতকরণের প্রভিশন রেখে আমরা সাইবার নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইন করেছি। তিনি বলেন, ডিজিটাল প্রগ্রেস (অগ্রগতি) সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে আইনটির নাম দেয়া হয়েছে সাইবার নিরাপত্তা আইন। এ আইনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সাইবার নিরাপত্তার জন্য যে ধারাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেগুলো এখানে অক্ষুণœ রাখা হয়েছে। সেগুলোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।

আইনমন্ত্রী বলেন, দ্বিতীয়ত, যেটি করা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারা, যেমন মানহানির যে ধারাটি ছিল, সেই ধারায় আগে শাস্তি ছিল কারাদণ্ড। সেই কারাদণ্ডের জায়গায় এখন জরিমানার বিধান করা হয়েছে। অর্থাৎ মানহানির একমাত্র সাজা জরিমানা। এখন জরিমানা যদি না দেয়া হয়, তাহলে কারাদণ্ড থাকবে। সেটাও জরিমানার ওপর ভিত্তি করে তিন মাস বা ছয় মাসের কারাদণ্ড থাকবে। কিন্তু মূল শাস্তি হলো জরিমানা। এখানে অনেক ধারা যেগুলো আগে অজামিনযোগ্য ছিল, সেগুলোকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে।

আইনমন্ত্রী জানান, তৃতীয়ত. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১-এ বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত- এসব নিয়ে যদি কেউ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে, তাহলে সেটিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। এর সাজা ছিল ১০ বছর কারাদণ্ড, এটি কমিয়ে এখন সাত বছর করা হয়েছে।

তিনি বলেন, অনেক ধারার মধ্যে ছিল, দ্বিতীয়বার যদি কেউ অপরাধ করে, তাহলে সেই সাজা দ্বিগুণ হয়ে যেত কিংবা সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হতো। প্রতিটি আইনে যেখানে দ্বিতীয়বার সাজার কথা আছে, সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। নতুন আইনে দ্বিতীয়বার অপরাধ করলেও প্রথমবার অপরাধ করলে যে সাজা থাকবে, দ্বিতীয়বারের জন্যও একই সাজা থাকবে। এ ছাড়া যেগুলো টেকনিক্যাল অপরাধ, যেগুলো সাইবার সিকিউরিটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোর বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

আইনমন্ত্রী বলেন, যেগুলো টেকনিক্যাল অফেন্স, সেগুলো কিন্তু আমরা জামিনযোগ্যও করিনি, সাজাও কমানো হয়নি, ৩০ ধারা থাকবে। ৩১ ধারায় আগে ছিল সাত বছর, এখন কমিয়ে আনা হয়েছে পাঁচ বছরে। ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধে আগে ছিল ১৪ বছর এখন সাত বছর করা হয়েছে। এখানেও পুনঃসংগঠন করলে যে শাস্তি, তা বাতিল করা হয়েছে।

আইনমন্ত্রী বলেন, হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধ বলে একটি অপরাধ এখানে নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে। সেটিতে ১৪ বছরের কারাদণ্ড করা হয়েছে। ৩৩ ধারায় বেআইনি তথ্য, উপাত্ত ধারণ, হস্তান্তর, স্থানান্তর ইত্যাদি, এটিকে হ্যাকিং নামে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আমার মনে হয়, ৩৩ ধারাটিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিংয়ের অপরাধ করা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি হ্যাক করেন, তাহলে সেটি হবে একটি অপরাধ। সেজন্য তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তিনি বলেন, হ্যাকিং মানে বলা হয়েছে, কম্পিউটারের তথ্যভাণ্ডার থেকে কোনো তথ্য বিনাশ বাতিল, পরিবর্তন, এর মূল্য বা উপযোগিতা হ্রাসকরণ, অন্য কোনোভাবে ক্ষতি সাধন, নিজ মালিকানা বা দখলবিহীন কম্পিউটার সার্ভার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে এর ক্ষতি সাধন।

কয়টি ধারায় পরিবর্তন হয়েছে, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, অনেক ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। মামলাগুলো চলবে। তবে মামলার যে কার্যক্রম, তা সাইবার নিরাপত্তা আইনে চলবে। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে আইনটি উঠবে, সেখানে এ আইনটি পাস করা হবে।

অন্য দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ পরিবর্তন করে নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত নিলেও এই আইনে চলমান মামলাগুলো বাতিল হবে না। মামলাগুলোর বিচার আগের আইনেই চলবে বলে জানিয়েছেন। গতকাল সোমবার সুপ্রিম কোর্টে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা বলেন, যখন কোনো আইন বাতিল বা পরিবর্তন করা হয়, তখন একটি সেভিং ক্লোজ দেয়া হয়। সেখানে বলা হয়, যে মামলাগুলো চলমান আছে সেই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে আইনটি বিলুপ্ত হয়নি। আইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্তকে তিনি ইতিবাচক বলে উল্লেখ করেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/768212