৭ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ১২:২৮

মশা ঠেকানোর খরচও বাড়ছে

ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মশা ঠেকানোর সামগ্রীর চাহিদা ও দামও বাড়ছে। দুই থেকে ছয় মাসের ব্যবধানে প্রতিটি পণ্যের দাম ১০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, মশার কয়েল, মশারি, স্প্রে, ভ্যাপোরাইজার, ক্রিম ও ইলেকট্রিক ব্যাট—সবটারই চাহিদা ও দাম বেড়েছে।

রাজধানীর পশ্চিম রাজাবার, কাঁঠালবাগান, কারওয়ান বাজার, শেওড়াপাড়া, বাড্ডা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাজার ও বিভিন্ন দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মশার কয়েলের বিক্রি বেড়েছে দ্বিগুণ। সবচেয়ে বেশি চাহিদা কয়েল ও মশারির। ইলেকট্রিক ব্যাট ও ক্রিমের মতো পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার কামড় থেকে বাঁচতে এসব উপকরণ ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
তাঁরা বাড়ির আঙিনা, ছাদ ও খোলা জায়গায় পাত্রে জমে থাকা পানি অপসারণ, শরীর ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা মশারি ব্যবহারের প্রতি জোর দিচ্ছেন, যা ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়ার কার্যকরী উপায়। তবে শহরের বাসাবাড়িতে স্প্রে, ভ্যাপোরাইজার, ইলেকট্রিক ব্যাটের ব্যবহার করছেন অনেকে। বাসায় মশারি ব্যবহার করলেও চা বা মুদি দোকানের ব্যবসায়ী ও আড্ডা দেওয়ার লোকেরা কয়েল জ্বালিয়েই মশা তাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

মশারির চাহিদা বেড়ে কয়েক গুণ
প্রায় সব ধরনের মশারির দাম ২০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারখানায় মশারির দাম বেশি রাখা হচ্ছে।

দুই মাস আগে পাঁচ ফুট বাই সাত ফুট বোনাফাইট মশারির দাম ছিল ৪০০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। ব্র্যান্ড ছাড়াও বিভিন্ন কারখানায় তৈরি মশারির দাম বেড়েছে।

একজন ব্যবহার করা যায় এমন মশারি আগে ছিল ১৬০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। ছয় ফুট বাই সাত ফুট মশারি আগে মানভেদে ১৮০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন ২০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

প্রায় ৪০ বছর ধরে কারওয়ান বাজারে খুচরা ও পাইকারি মশারি বিক্রি করেন মো. আব্দুর রহিম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে সব ধরনের মশারির দাম বেড়েছে। আমরা কারখানা থেকে কিনে আনি। সেখানে বেশি দাম রাখলে আমাদের কিছু করার থাকে না।’ তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে বিক্রি অনেক বেড়েছে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি মশারি বিক্রি হচ্ছে। আগে ১৫টিও বিক্রি হতো না।

তেজগাঁও থেকে মশারি কিনতে এসেছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী ওয়ালিউর রহমান। ম্যাজিক মশারি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দোকানদাররা মনে করেন আমরা কিছু বুঝি না। ম্যাজিক মশারির কথা বলে তাঁদের পণ্য উন্নতমানের বোঝাতে চান। এ ছাড়া কিছু না।’

দাম বেড়েছে কয়েলের
এসিআই কম্পানি মশার কয়েল উৎপাদন করলেও তা অন্তত ১৫টি দোকান ঘুরেও পাওয়া যায়নি। যারা পাড়া-মহল্লায় রিকশা বা ভ্যানে টয়লেট্রিজ পণ্য সরবরাহ করেন তাঁরা অপরিচিত কম্পানির কয়েল সরবরাহ করেন। ফলে ক্রেতারা বাধ্য হয়ে ওই সব কয়েল কিনছেন। বেশি পাওয়া যাচ্ছে নতুন নামের কয়েল। তাঁরা বলছেন, কয়েলের বিক্রি বেড়েছে দ্বিগুণ। প্রতি প্যাকেটে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। ‘বাবা-মা’ নামের কয়েল তিন মাস আগে ছিল ৮৫ টাকা প্যাকেট, এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। ‘সুপার নাইট মসকিউটো’ আগে প্যাকেট ছিল ৭০ টাকা, এখন ৮০ টাকা। ‘চ্যালেঞ্জ হিট’ প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়, আগে ছিল ৫০ টাকা।

রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরের বিক্রয়কর্মী সুমন বলেন, ‘সুপার নাইট মসকিউটো, বাবা-মা ও চায়না কম্পানির কয়েল আছে আমাদের দোকানে। কম্পানির নাম বলতে পারি না। গাড়ি নিয়ে এসে দিয়ে যায়। আমরা বিক্রি করি। বাবা-মা কয়েল ১০ পিসের প্যাকেট ১০০ টাকা। প্রতি পিস ১০ টাকা। এটা আগে ৮৫ টাকা প্যাকেট ছিল। সুপার নাইট মসকিউটো ৮০ টাকা প্যাকেট, এটার দাম আগে ছিল ৭০ টাকা।’ ভালো কম্পানির কোনো কয়েল আছে কি না জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘ওগুলো আমাদের দেয় না। কম্পানির লোক এখানে আসেন না।

স্প্রে ও ভ্যাপোরাইজার
বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বেশি পাওয়া যায় এসিআই কম্পানির অ্যারোসোল স্প্রে। কম্পানিটি তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করেছে, দেশের অ্যারোসোল স্প্রের চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করে তারা। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এই কম্পানির ৪৭৫ মিলি লিটারের ক্যান এখন ৪১৫ টাকা। গত জানুয়ারিতে ছিল ৩১৫ টাকা। বাড়ানো হয়েছে ১০০ টাকা। ভারত থেকে আমদানি করা ‘হিট স্প্রে’ দুই থেকে তিন মাস আগে ২০০ মিলি লিটারের দাম ছিল ১৬৫ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। ৪০০ মিলি লিটারের দাম ছিল ২৪০ টাকা, এখন দাম বাড়িয়ে ৩২৫ টাকা করা হয়েছে।

ডলারের দাম বাড়ার পর মরটিন ///ভ্যাপোরাইজার (৪৫ এমএল) ১৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২০ টাকা; গুডনাইট লিকুইড ভ্যাপোরাইজার (৪৫ এমএল) ১০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করা হয়েছে।

কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের দোতলায় অবস্থিত আদর্শ এন্টারপ্রাইজ। এই দোকানের মালিক মো. বজলুর রশিদ বলেন, এসিআই ও ভারতীয় কম্পানির হিট স্প্রে, স্কয়ার কম্পানির এক্সপেল স্প্রে আছে। স্প্রে বিক্রি বেড়েছে। এগুলোর দাম যা বেড়েছে দুই-তিন মাস আগেই বেড়েছে। এখন দাম বাড়েনি। তবে ভারতীয় কম্পানির ‘হিট’ আগের চেয়ে দাম বেড়েছে। আগে ২৪০ টাকা ছিল, এখন এটা ৩২৫ টাকা বিক্রি করতে হবে। গত তিন দিনে ৫০ পিস স্প্রে বিক্রি হয়েছে। স্প্রে বা কয়েল যাই বলেন, ‘যদি আগে ১০টি বিক্রি করতাম এখন সেটা ২০টি বিক্রি হচ্ছে। মানে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তুলনামূলক দাম বেড়েছে।’

শরীরে মাখার ক্রিম
বাজারে বাংলাদেশের নোমস ও ভারত থেকে আমদানি করা ‘ওডোমাস’ ক্রিম পাওয়া যায়। ওজনভেদে এর দাম ১২০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। তবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সোলমাইদ বাজারে পাঁচটি দোকানের মধ্যে তিনটিতেই কোনো ক্রিম পাওয়া যায়নি। বিক্রেতারা জানান, কয়েক মাস আগে ওডোমাস ১০০ গ্রাম ক্রিমের দাম ছিল ২০০ টাকা। এখন ২৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। এই বাজারের তালুকদার ফার্মেসির বিক্রেতা মো. রাকিব বলেন, ‘দেশি বা বিদেশি কোনো ক্রিমই নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। কম্পানির সরবরাহ নেই। যে পরিমাণ চাহিদা, সে অনুযায়ী দিতে পারছে না।’
মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট

বিভিন্ন কম্পানির ব্যাট পাওয়া যায় বাজারে। এর মধ্যে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ওয়াল্টনের ডাব্লিউএমবিটি-০০১ মডেলের ব্যাটের তিন মাস আগে দাম ছিল ৬৮০ টাকা। এখন ১৮০ টাকা বাড়িয়ে ৮৬০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ভিশন কম্পানির ব্যাট ৪৭০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বাড়িয়ে ৫২০ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ানোর পর ডিসকাউন্ট দিয়ে ৪৭০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। চীন থেকে আমদানি করা ‘এসএ’ ব্যাট আগে ছিল ৩৫০ টাকা। ১০০ টাকা বাড়িয়ে এখন ৪৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

দাম বাড়ানোর বিষয়ে শোরুমের বিক্রেতারা দাবি করেছেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে এসব ইলেকট্রনিক পণ্যের দাম বেড়েছে।
শেওড়াপাড়া ভিশন ইলেকট্রনিকস বিক্রয় কেন্দ্রের ম্যানেজার মো. অনিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত মাস থেকে ১০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছে। মোট মূল্য থেকে এটা বাদ দিলে ৪৭৪ টাকা আসে, বিক্রি করছি ৪৭০ টাকায়।’

ডেঙ্গু থেকে রক্ষার উপায়
সঠিক মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার না করলে সিগারেটের চেয়েও বেশি ক্ষতি করতে পারে মশার কয়েল। কয়েলের ধোঁয়া ফুসফুসের ক্ষতি করে বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কয়েলে কীটনাশক ব্যবহারের একটি মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও), কিন্তু দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেনামে যে কয়েল উৎপাদন করা হয় সেগুলোতে তার চেয়ে বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, যা ঠিক না। তবে বড় বড় কম্পানি, যারা বিএসটিআইয়ের অনুমতি নিয়ে কয়েল প্রস্তুত করছে, তাদের মধ্যে বেশি কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতা নেই। তাদের কয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।’

মশা তাড়ানোর উপকরণ ব্যবহারের চেয়ে সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করেন এই কীটতত্ত্ববিদ। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকে প্রথমত নিশ্চিত করতে হবে, বাসার আশপাশে যেন পানি জমে না থাকে। জমে থাকলে পানি ফেলে দিতে হবে। যে পানি ফেলে দেওয়া সম্ভব নয় তার মধ্যে কেরোসিন তেল বা মবিল ঢেলে দিতে হবে। এরপর বাসায় মশারি ব্যবহার করতে হবে। সন্ধ্যার আগেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে হবে। হাফ হাতা শার্ট পরা যাবে না। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর আগে মোজা, ফুল হাতা শার্ট পরিয়ে দিতে হবে। অফিসে যাঁরা যান তাঁদেরও হাফ হাতা শার্ট পরা বাদ দিতে হবে। এর বাইরে স্প্রে, ক্রিম ব্যবহার করতে হবে।

বিএসটিআইয়ের নির্দেশনা না মেনে কেউ কয়েল উৎপাদন করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি ডিরেক্টর ও মুখপাত্র মো. রেজাউল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠান আমাদের অনুমতি ছাড়া মশার কয়েল প্রস্তুত করছে সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। অভিযান পরিচালনা করছি।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/08/07/1305998