৭ আগস্ট ২০২৩, সোমবার, ১২:১৫

‘সময় গেলে সাধন হবে না’

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে ভাববাদী গীতি ও চারণ কবিরা, সাধু সন্ন্যাসীরা যে বাণী ও বয়ান রেখে গেছেন তা অনুভবের আয়নায় প্রতিফলনের সময় ফুরিয়ে যায় না। কেননা, দিন থাকতে দ্বীনের সাধনার কথা ভুলিয়ে দেয়ার প্রথম প্রয়াস আদি মানব মানবীর জীবনে স্বর্গ হতে বিদায়ের কারণ হিসেবে এসেছিল, এখনো যা আছে অব্যাহত। শিক্ষা নেয়ার জন্য ইতিহাস অধ্যয়ন, সময়ের উত্থান-পতনের পটভূমি বোঝানোর জন্য অতীত রোমন্থন, কিন্তু সেই ইতিহাস যদি প্রতিষ্ঠা ও নির্মাণের নামে চর্বিত চর্বণে বিকৃত বিকারগ্রস্ত করা হয়; তাহলে অতীত অনুসরণের মৌল ভূমিকায় ঘটে বিপত্তি। যে অনুসরণ বার বার ভুলিয়ে দিয়ে যায় সময়ের প্রবহমানতা, অতীত থেকে শিক্ষা নেয়ার পরিবর্তে বর্তমানকে দায়দায়িত্বহীন করার প্রয়াস প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতে শুধু অন্ধকার অপেক্ষা করে। মানব সভ্যতার উত্থান, বিকাশ ও পতনের নাড়িনক্ষত্র ঘাঁটলে এ সত্যই বেরিয়ে আসে যে, মানুষই সভ্যতা সমৃদ্ধির স্রষ্টা, আবার এই মানুষই তার ধ্বংসকারী। বলা বাহুল্য, মানুষই মানুষের শত্রু, যে শত্রুতা আদি মানব-মানবীর প্রথম সন্তানরা পোষণ করতে প্ররোচিত হয়েছিলেন অশুভ প্রবণতা প্রবৃত্তির দ্বারা। এ প্ররোচনা এখনো চলছে, চলছে বলে স্বার্থান্ধ হয়ে অতীতের কাছে আশ্রয় মাঙতে গিয়ে বর্তমানকে উপেক্ষার উপলক্ষ মিলে যায়। ভবিষ্যৎ কেন কিভাবে অগ্রসরমান হবে সে বিবেচনার সুযোগ হয় হাতছাড়া। এ কথা মাথায় রাখতে হবে-আজকের বর্তমান একদিন অতীত হবে, বর্তমানকে সময়ের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং তখন বর্তমানের কর্মসাফল্য দিয়ে বর্তমানের জাত কুল মান রক্ষা করা কঠিন হবে।

বর্তমানের কর্তব্য কর্মসাধনা বর্তমানে বসেই করতে হবে। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে যে সময়ের যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ শুরু ও শেষ করতে হবে। বর্তমানকে সমৃদ্ধশালী, গুণগতমান সম্পন্ন ও অধিকতর উপযোগী করতে অতীতের ব্যর্থতা ও সাফল্যকে শিক্ষা এবং প্রেরণা হিসেবে সচেতন অনুসরণে আসতে পারে, অতীতের গৌরবকে সর্বকালীন ও সর্বজনীনকরণের ভার সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হয়, বর্তমানে অতীতকে অতিমাত্রায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে, অতীতের গুরুত্ব যেমন হ্রাস পায়, তেমনি বর্তমানে ভালো কিছু করার সময় ও সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এটি মানব ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সব সময় সীমালঙ্ঘন বা মাত্রা অতিক্রমণই বুমেরাং হয়ে ফিরেছে। ফিরোজ শাহ তুঘলক দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করতে গিয়ে বাড়াবাড়িতে আম-ছালা দুটোই খুইয়েছিলেন। ভাববাদী সমাজে সমতার পরিবর্তে বৈষম্যের বাড়াবাড়িতে সংহতির সংসারে ভাঙন হয়ে ওঠে অনিবার্য। সীমালঙ্ঘনের সমস্যায়, মাত্রাতিক্রমণের প্রবণতায়, প্রগলভতার প্রতারণায় বহু সভ্যতার ভরাডুবিতে ভুগেছে মানুষ। মহামারীতে সম্বিত ফিরেছে, আবার ফেরেনি। যতদিন যতটা ফেরেনি মহামারীও পিছু ছাড়েনি। এটি প্রকৃতির নিয়ম। প্রগলভতা, প্রতারণা, প্রসঙ্গ পাল্টানো ও অন্যের ওপর দোষ চাপানো দ্বারা বর্তমানের অনাচার ও সমূহ সর্বনাশ আড়াল করা যায় না, এটি প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ এবং অপেক্ষার পালা সাঙ্গ হলে বিচারে বা প্রতিশোধে নামে প্রকৃতি নিজেই।

মরহুম চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে স্মরণ করেছিলেন দু’টি ঘটনা-
‘প্রথমত, শিশুদের জন্য পথকলি নামে এক সংস্থায় কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো বর্তমান শেরাটন হোটেলের উত্তর দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাড়িতে। আমি তৎকালীন সরকারপ্রধানের কাছে তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে একটি জায়গা চেয়েছিলাম। সেটি হলো মিরপুরের এশিয়া সিনেমা হলের উল্টো দিকে। এক বিঘা জমিতে একটি টিনের ঘর করে সেখানে আউটডোর শুরু করা যেত। তখন পথকলি ট্রাস্ট গঠনের লক্ষ্যে অনেক টাকাও উঠেছে, সেই টাকা দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান চালানোর উদ্যোগ নেয়া যেত। হাসপাতাল ও মসজিদ সবাই চান, কেউ এর বিনাশ চান না। সরকারপ্রধান বললেন, পরে হবে। বাড়িটি তো কেউ নিচ্ছে না, এখানে কাজ চলতে থাকুক। আমি স্থায়ী জায়গার জন্য আবেদন জানাই। তিনি বললেন, দেখা যাক- পরে হবে। কিছু দিনের মধ্যে পটপরিবর্তন হলো। পথকলি ট্রাস্ট বন্ধ হয়ে গেল। সব শেষ। অসচ্ছল শিশুদের সেবার সুযোগ মিলিয়ে গেল।
দ্বিতীয়ত, তৎকালীন আইপিজি এম আর বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম পার্শ্বে একটি জায়গা ছিল। আমি ও প্রফেসর নূরুল ইসলাম এ হাসপাতাল বর্ধিত করার লক্ষ্যে ওই জায়গাটি হাসপাতালের নামে বরাদ্দের জন্য ভূমিমন্ত্রী আব্দুল হকের সাথে দেখা করি। কয়েক দিন যাতায়াতের পর সেখানে দেখলাম খুবই হইচই। আমি মন্ত্রীকে অনুরোধ জানালাম, স্যার কাজটি ভালো মনে করলে আজকে করে দিন। আপনার এখানে যে অবস্থা না জানি আপনি কয়দিন এ দায়িত্বে থাকবেন? মন্ত্রী বললেন, আজ তো অফিস প্রায় শেষ; কালকে আসেন। আমি বললাম, কালকে আপনি এ পদে নাও থাকতে পারেন। সবাই আমার কথায় অবাক। বললাম, আজকে সম্ভব হলে করে দিন। সন্ধ্যায় আমাদের পিএকে টাইপ মেশিনসহ তার কাছে পাঠালাম, রাতের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেল। ভাগ্যের পরিহাস, পরের দিন তার মন্ত্রিত্ব চলে গেল। সুতরাং শুভস্য শীঘ্রম কত উপকারী। আমার এই দু’টি ঘটনা বলার উদ্দেশ্য- প্রথমটি পরে করবেন বলে রেখে দিলেন কিন্তু আর করতে পারলেন না। আর দ্বিতীয়টি তিনি যদি ওই দিন রাতে না করতেন তাহলে হয়তো এটিও হতো না।’

উপলব্ধির বিষয় হলো- মানুষ বাঁচে আশায়, পরিবার-প্রতিবেশী-সমাজ ও দেশ বাঁচে ভালোবাসায়। আমরা কত আশা করি এটা-ওটা কত কিছু করব। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আছে, ইচ্ছার তালিকা, প্রত্যাশার তালিকা বড় হয়ে চলেছে, কিন্তু আল্লাহ জানেন আমরা কতদিন আছি। এমনও মনে হয় ভালোই তো আছি, অন্যদের কিছু হলেও আপাতত আমার বা আমাদের কিছু হবে না। ধন্য আশা কুহকিনী, আমাদের ভুলিয়ে রাখে, প্রবহমান সময়ের সাথে নদীর স্রোতও গতিহারা হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকে সময়ের হাতে বন্দী, প্রত্যেকে যার যার জগতে, এখতিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ নিজের ও পরের জন্য। সুতরাং যখন যিনি যেটি ভালো মনে করেন এখনই বা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করবেন। এ সুযোগ আর নাও আসতে পারে। শুভস্য শীঘ্রম।’ লেভ টলস্টয় তার গোটা জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে বলেছিলেন, বর্তমানই সেরা সময় ( নাউ ইস দ্য বেস্ট টাইম) ।

প্রত্যেক ব্যক্তি সমাজ ও দেশে নিজ নিজ মূল্যবোধ চিন্তা-চেতনার বলয়ে থেকেই তার অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তুলতে পারে। অপরের আনন্দ-সর্বনাশের উদাহরণ টেনে নিজের বা নিজেদের বেপথে চলার যুক্তি দাঁড় করানো আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল। প্রতিটি সমস্যা মোকাবেলায় নিজে বা নিজেরা যদি যথাসচেতন ও কার্যকর পদক্ষেপে না থাকি, অন্যেরা এসে থামাতে বা নামাতে সাহায্য করবে- সেই ভরসায় বসে থাকি, অন্যের মুখাপেক্ষী থাকা মানে নিজের বল ক্ষয় করা, নিজের সামর্থ্য ও আশা আকাক্সক্ষা জলাঞ্জলি দেয়া, সে কথা বোঝার জন্যও যদি অন্যকে ত্রাতা ভাবি তাহলে প্রতিপক্ষরা সে সুবাদে আমার কাটা খালে কুমির হিসেবে আসবেই। নিজেদের মধ্যকার বিভেদের দেয়াল নিজেদের ভাঙতে বিভেদ, বৈষম্য ও পারস্পরিক অনাস্থার জায়গায় জঞ্জাল জমানোর পরিবর্তে সেগুলো অপসারণ অপনোদনে যত্নবান হওয়ারও এখনই সময়। স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ সঙ্কুুচিত হলে নিজের অকর্মণ্যতা কিংবা স্বসংহারের উপলব্ধিটাও ভোঁতা হয়ে যায়। ‘জানো না মন খালে বিলে থাকে না মিন জল শুকালে, কি হবে আর বাধা দিলে শুকনা মোহনা। অসময়ে কুষি কইরে মিছামিছি খেইটে মরে, গাছ যদিও হয় বীজের জোরে, ফল ধরে না...’
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/767820