৬ আগস্ট ২০২৩, রবিবার, ১১:৫১

তারুণ্যকেই জাগতে হবে

-জাকির আবু জাফর

একটি জাতির নতুন সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে কারা? এর জবাবে বোধ করি সবাই এক সুরেই বলবেন, তারুণ্যই জাতির সম্ভাবনার নতুন সূর্য! হ্যাঁ, জবাবটি যথার্থ। কেননা, সব বাধা ভেঙেচুরে পথ চলার হিম্মত কেবল তারুণ্যই রাখে। তারুণ্যের বুকেই থাকে নতুন দিনের প্রবল জোয়ার। থাকে বাঁধভাঙা বানের জলের মতো আবেগ।

একটি সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হাত তারুণ্যই উঁচু করে। এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বা শাসন ক্ষমতার পরিবর্তনেও থাকে তারুণ্যের হাত। যেকোনো লড়াই সংগ্রাম প্রতিরোধে তারুণ্যের পা থাকে অগ্রবর্তী। আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসও এই সাক্ষ্য হাজির করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনঝরা দিনগুলোর দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

একটি সমাজকে এগিয়ে নেয়ার কাজটি তারুণ্যই করে থাকে। না, শুধু তারুণ্যের কথা বলছি না। এগিয়ে যাওয়ার পথে আরো আরো শক্তি কাজ করে। যারা বয়সী, যারা শিক্ষিত, একদিন তারাও তরুণ ছিলেন। তাদেরও ছিল তারুণ্যভরা প্রাণ। তারাও নতুন কিছু করার সাধনা করেছেন। সেই সাধনার পথ থেকে তারা সঞ্চয় করেছেন বিপুল অভিজ্ঞতা। এখন যারা তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত, তাদের জন্য প্রবীণদের অভিজ্ঞতা খুব প্রয়োজন। তারুণ্যের সাহস আর প্রবীণের অভিজ্ঞতা যোগ হলে সমাজকে এগিয়ে নেয়া সহজ হয়।

কিন্তু এগিয়ে নেয়ার কাজটি তারুণ্যকেই করতে হয়। কোনো জবরদখলের কবল থেকে মুক্তি পেতেও তারুণ্যের উপস্থিতি জরুরি। তাই বলতেই হয়, সমাজ বা রাষ্ট্রের যেকোনো পরিবর্তন তারুণ্যের মুখাপেক্ষী।

‘নতুন কিছু করাই তারুণ্যের ধর্ম’- কথাটি জর্জ বার্নার্ড শ’র। বচনটি একদম খাঁটি! তারুণ্যের রক্তের ফোঁটা থেকে জন্মায় নতুন বিপ্লব। তারুণ্যের দৃপ্ত পদভারে জাগ্রত হয় জীবনের নতুন ধ্বনি। তারুণ্যই নতুন স্বপ্ন গড়ে। পুরনো স্বপ্নকে নতুন করে তোলে। নতুন স্বপ্নকে করে বৃহৎ। এসব স্বপ্ন ছড়িয়ে দেয় জাতীয় জীবনে। পুরনো জীর্ণতার খোলস ছাড়িয়ে নতুন আনন্দের উত্তাপ আনে তারুণ্য।

তারুণ্য মানেই নতুন রক্ত। নতুন উদ্যম। নতুন স্বপ্ন। নতুন পথের যাত্রী। তরুণরাই একটি জাতির শক্তি। তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তরুণরাই সমাজের প্রতিবাদ। তরুণরাই সত্য ও সুন্দরের পতাকাবাহী।

কিন্তু আমাদের সমাজে তারুণ্যের অবস্থান কী! কোথায় আমাদের তারুণ্যের ঠিকানা। আমাদের তরুণরা কেমন করে আছে। কী অবস্থান তাদের। আমরা কি আমাদের তারুণ্যকে কখনো নতুন সম্ভাবনার জায়গায় ভেবেছি! নাকি ভাবছি! অথবা ভাবব বলে ইচ্ছে রাখছি!
এসব জিজ্ঞাসার একটিই জবাব, না। অবস্থাটি কি তবে! আমাদের তারুণ্যের দিকে আমাদের সমাজপতিদের এতটুকু নজরও কি আছে! নাকি ছিল! আছে কি কোনো পরিকল্পনা! এর জবাবও সেই ‘না’।

তারুণ্যকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার দায়িত্বটি কার? যারা সমাজকে রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেন তাদের নয় কি! কিন্তু তারা কতটা পালন করেছেন তাদের দায়িত্ব! পালনে কতটা সচেতন ছিলেন! নাকি আছেন! ভবিষ্যতে কেউ থাকবেন কি না আগাম বলার অবকাশ নেই। তবে আশা রাখতে তো দোষ কি। আমরা আশা রাখি হয়তো ভবিষ্যতে কেউ না কেউ একদিন তারুণ্যের মনকে শাণিত করবেন। স্বপ্নকে দীর্ঘ করে তুলবেন। সে কথা ভবিষ্যতের!

বর্তমানের কথায় আসি। জাতির ভবিষ্যৎ এই কাণ্ডারীদের সামনে অন্তত একটি আইকন থাকতে হয়। থাকাটা অপরিহার্য। যাকে সামনে রেখে তুমুল বেগে এগিয়ে যাবে তারুণ্য। যাকে আদর্শ জ্ঞান করে তারা গড়ে নেবে নিজেদের। যাকে দেখে তারা বলবে, আমাকেও হতে হবে এমনই উঁচু মাপের মানুষ।

কিন্তু কই আমাদের আছে কি তেমন কোনো মুখ! আছে কি তেমন কোনো আইকন! যাকে অনুকরণ করা যায়! যাকে অনুসরণ করে হওয়া যায় বড়! যাকে সামনে রেখে চলা যায় পথ! তেমন একটি মুখও কি আছে যাকে আমরা বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছি! যার শরীরের পোশাক-পরিচ্ছদ ঠিকঠাক রেখেছি। যাকে নিয়ে আমরা অশোভন ঘাঁটাঘাঁটি করিনি! কিংবা যে বিতর্কের জাঁতাকলে পিষ্ট নয়! আমাদের জাতীয় জীবনে একজনও কি নেই তেমন মানুষ! কিন্তু আমরা কি পেরেছি সেই সে মানুষের ইজ্জত রক্ষা করতে! পারিনি! পারিনি কারণ আমরা মন-মানসিকতায় ভীষণ নিচুস্তরের মালমসলায় গড়া। রুচির দিক থেকে ভীষণ নিম্ন। ফলে আমরা কারো মর্যাদা রক্ষা করার সৌজন্যটুকুও দেখাতে ব্যর্থ। কী করে আমাদের তারুণ্য উচ্চ মানসতায় বেড়ে উঠবে!

আমাদের সমাজ এবং সমাজের নিয়ম পদ্ধতির ভেতর কি আছে এখন? আছে কি তারুণ্যের শেখার মতো কোনো নীতি নৈতিকতা! আছে কি নিজেদের পরিশুদ্ধ করার কোনো আদর্শ! এর জবাবও হ্যাঁ হওয়ার কোনো জো নেই।

তাহলে আমাদের তারুণ্য বিভ্রান্ত হবে এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে! আমাদের গোটা তরুণ সমাজ ডুবে আছে সামাজিক যোগাযোগ নামক এক ভয়াবহ নীল বিষের জলে। তারুণ্যের কাছে রাত এখন রাত নেই। রাত হলো মুঠোফোনের নীলাভ আলোর খেলার জগৎ! চোখের পাতা এক না হওয়ার এক অদ্ভুত নেশায় খরচ হয়ে যায় রাত। তারুণ্যের চোখে শুকিয়ে গেছে ঘুমের নদী। সারারাত নেট দুনিয়ায় ঘুরে বেড়িয়ে শেষ হয় রাত। যখন নতুন দিনের শুভেচ্ছা নিয়ে উঠে আসে সূর্য ঠিক তখন চোখের পাতা জোড়া করে এসব তরুণ। ফলে এদের কাছে দিনও এখন আর দিন নেই। দিন হলো আধো ঘুম আধো জাগরণের এক কর্মহীন সময়। অবেলায় ঘুম থেকে ওঠা। উঠেই আবার সেই মুঠোফোনে গুঁতোগুঁতি। সঙ্গে আলস্যে ঝিমানো এবং নেতানো ভঙ্গির মনমরা দৃষ্টি। এমন তারুণ্য দিয়ে নতুন কিছু তো দূরে, পুরনোটাও ধরে রাখার উপায় নেই।

এ সুযোগটিই নিচ্ছে সমাজের দুর্বৃত্তরা। সমস্ত অধিকার লুণ্ঠন করে মুখে তালা লাগিয়ে দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন প্রায়। নাগরিক অধিকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের হিড়িক এখন চতুর্দিকে। সামনে শোনা যাচ্ছে আরো কঠিন সময়ের পদধ্বনি। সুতরাং এখন তারুণ্যকে জাগতেই হবে। 
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, শিশু-সাহিত্যিক, গীতিকার ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/767547