৫ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ১:৪৪

হিসাবের বাইরে হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী

ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই ডেঙ্গু হানা দেয়। ইতিমধ্যে মৃত্যুতে দেশে ডেঙ্গুতে রেকর্ড হয়েছে। প্রাণহানি ৩০০-এর কাছাকাছি। আক্রান্ত ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর যে হিসাব দিচ্ছে তার বাইরেও হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। যাদের নাম হিসাবের খাতায় নেই। অনেক হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দিচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু রোগীর সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়লেও তা মোকাবিলায় কী করছে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগ। তা নিয়ে জনমনে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবং প্রস্তুতি নিয়ে কথা হয় দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির (কোভিড) অন্যতম সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম-এর সঙ্গে। তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ বছর এটি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর যে হিসাব দিচ্ছে তার বাইরেও হাজার হাজার ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। হিসাবের খাতায় তাদের নাম নেই। অনেক হাসপাতাল ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দিচ্ছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। ফলে ডেঙ্গু রোগীর সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এজন্যই দিন দিন সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় রোগীরা বেশি ঢাকামুখী হচ্ছেন। তিনি বলেন, করোনার সময় প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ দেয়ার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন দেখছি না।

হাসপাতালে লোকবল নেই, বেড নেই। অনেক হাসপাতালেই রোগীকে মশারিও দেয়া হয় না। এই চিকিৎসক সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগকে ডেঙ্গু মোকাবিলায় আরও উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, বছরের শুরুতেই তাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি দ্রুতই ডেঙ্গু মোকাবিলায় হাসপাতালগুলোকে ভালোভাবে প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে মশা মারার উপর গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই ভাইরোলজিস্ট।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে খ্যাতিমান মেডিসিনি বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে হিসাব আসছে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। অনেকের ঘরেই জ্বরের রোগী আছে, চিকিৎসা নিচ্ছে না। ঘরে থেকেই ভালো হয়ে যাচ্ছে। সেগুলোতো রিপোর্টে আসে না। এভাবে যদি বাড়তে থাকে অবস্থা আগামী এক থেকে দুই মাসে আরও খারাপের দিকে যাবে। যত আক্রান্ত হবে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যাবে। ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্তের তেমন দরকার নেই জানিয়ে এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু হলে আবার অনেক রক্ত দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে যায়। তবে রক্ত দেয়ার দরকার নেই ডেঙ্গু মশার জন্য। রক্ত তখনই লাগে যখন রোগীর রক্তপাত হয়। সেখানে চিকিৎসক চাইলে রক্ত দিতে পারে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে খুব বেশি প্লাটিলেট প্রয়োজন হয় না। যারা মারা যায় তারা প্লাটিলেট কমের জন্য মারা যায় না। অনেক মারা যায় প্লাজমা লিকেজের ফলে। শরীর থেকে লিক্যুইড চলে যায়। যেমন প্রেসার কমে যায়, প্রস্রাব হয় না, কিডনি ফেইলিউর, লিভার ফেইলিউর শকে চলে যায়।

কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এবছর মে মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন কমিউনিটিতে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে। এরপর জুন-জুলাইয়ে গিয়ে আমরা ব্যাপক ডেঙ্গু রোগী পেলাম। জ্যামিতিক হারে এডিস মশা বেড়ে গেছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর আমাদের জন্য বেশ শঙ্কার। এবার মৃত্যুতে এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বাংলাদেশের ইতিহাস ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, প্রতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এবার লক্ষ্য করছি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। এর পেছনে কারণ কি? আমরা যদি একটু পেছনের লক্ষ্য করি দেখবো, ফিল্ড লেভেলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে যত ডেঙ্গু হয়েছে, দেখবেন আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। ২০২১ সাল পর্যন্ত এ দু’টি মাসের একটি মাসে ডেঙ্গু পিক ছিল। ২০২২ সালে দেখলাম নভেম্বর, ডিসেম্বর পার হয়ে চলতি বছরে জানুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গু চলে আসছে। এ জানুয়ারিতেও ৫০০’র মতো ডেঙ্গু রোগী ছিল। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল না। ঢাকা শহরে ‘লাইট পলিউশনের’ কারণে এডিস মশা এখন দিনে হোক বা রাতে সব সময় কামড়ায় জানিয়ে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, লাইট পলিউশনের বিষয়টি আমরা তিন বছর ধরে গবেষণা করে প্রমাণ করেছি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বেই হঠাৎ তাপদাহ বা অতিবৃষ্টি হচ্ছে। তাই সারা বছরই ডেঙ্গু থাকবে। তবে বর্ষার শুরু এবং শেষে এর প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি থাকবে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতি হয়ে উঠে ভয়ঙ্কর। আগস্ট মাসে আরও বাড়তে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু সংক্রমণ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে থাকবে। এরপর ধীরে ধীরে কমবে। যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে, সংক্রমণ আগস্টে শীর্ষে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এবারের সংক্রমণকে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় ঢেউ বলা যায়। কারণ গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নভেম্বর-ডিসেম্বরের পর একটু কম ছিল। চলতি বছর মার্চ থেকে বাড়তে শুরু করে।

স্যালাইনের ঘাটতি: ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বেড়েছে স্যালাইনের চাহিদা। এই চাহিদাকে পুঁজি করে একদিকে বেড়েছে দাম, অন্যদিকে দেখা দিয়েছে সংকট।

সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য বিনামূল্যে স্যালাইন সরবরাহ করা হয়। বেসরকারি হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয় শিরায় প্রয়োগের ডিএনএস (ডেক্সট্রোজ নরমাল স্যালাইন) স্যালাইন। সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিডেট (ইডিসিএল) বেসরকারি ওষুধ কোম্পানি এক্‌মি, পপুলার, ওরিয়ন, বেক্সিমকো, স্কয়ার, লিব্রা ও অপসোনিন এর কাছ থেকে স্যালাইন কিনে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে থাকে। সংকট দেখা দেয়ায় গোপালগঞ্জে নিজস্ব কারখানায় স্যালাইন উৎপাদন করা হবে বলে জানিয়েছেন ইডিসিএল’র কর্মকর্তারা। ডিএনএস স্যালাইনের দাম মাত্র ১০০ টাকা হলেও বিভিন্ন ফার্মেসিতে বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে, ডায়রিয়া বা কলেরা হলে অথবা কখনো কখনো রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখার জন্য শিরায় দেয়া স্যালাইন ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাউদ্দিন শাহ বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। তিনি বলেন, একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার স্যালাইন দিতে হয়, কোনো কোনো রোগীর এর বেশি প্রয়োজন হতে পারে।

https://mzamin.com/news.php?news=67924