৫ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ১:৩২

ঢাকায় মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

-ধারণক্ষমতার চারগুণ মানুষ

মানুষের চাপে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে ঢাকা। ধারণক্ষমতার চারগুণ লোকের এ নগরীতে নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা ভেঙে পড়েছে। স্থান পেয়েছে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায়। অসহনীয় মাত্রায় বেড়েছে তাপমাত্রা। যানজটে নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য কর্মঘণ্টা। এতে বিশাল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে অর্থনীতি। নদী দখল, সবুজায়ন, খাল, জলধারা ধ্বংসে সৃষ্টি হয়েছে পারিপার্শিক বিপর্যয়। এমতাবস্থায় আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ম্যাক্রোট্রেন্ডসের তথ্য মতে, ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ২ কোটি ৩২ লাখ ১০ হাজার। আর জনশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে বসবাসকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীর ৬৩% এলাকায় প্রতি একরে ৩০০ জনের বেশি মানুষ বাস করে। এর মধ্যে জনবসতির দিক দিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।

সমীক্ষা বলছে, গত ২৮ বছরে রাজধানী থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার উধাও হয়ে গেছে। এ সময়ে প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার সবুজের মৃত্যু হয়েছে।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। সেই তুলনায় দেখা যায় ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ শতাংশ জায়গায়।

অন্য দিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে, রাজধানীতে ধারণক্ষমতার চেয়েও প্রায় ছয় গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করছে। কিন্তু ঢাকা শহরের রাস্তায় দৈনিক দুই লাখ গাড়ি চলাচলের সক্ষমতা আছে, কিন্তু গাড়ি চলাচল করছে ১২ লাখ। ফলে যানজট লেগেই থাকছে।

ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রকাশিত দ্য গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৩-এর প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকা ১৬৬তম অবস্থানে। তালিকায় ১৭৩টি দেশের মধ্যে এ নগরীর অবস্থান নিচের দিক থেকে সপ্তম।

বিরাজমান পরিস্থিতিতে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিস্ফোরণোন্মুখ ঢাকায় ইতোমধ্যে পারিপার্শ্বিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এখনই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে না এলে এক দশকের কম সময়ের মধ্য এখানে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে।

পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকা ৩০০ বর্গ কিলোমিটার। এই এলাকায় খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকলে তাতে ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ বসবাস করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে মূল ঢাকাতে এক কোটির বেশি মানুষ বসবাস করছে। আর গ্রেটার ঢাকায় বাস করছে আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ। তার মধ্যে হলো গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ সব মিলে এখানে বাস করছে আড়াই কোটি মানুষ। তার মানে ধারণক্ষমতার চারগুণ মানুষ বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছে। এমন ক্ষুদ্র জায়গায় এত মানুষের বসবাস পৃথিবীর খুব কম জায়গায় আছে। আর বিশে^র যে দুই-এক জায়গায় এমনটা আছে তাতে তারা খুব পরিকল্পনা মাফিক শহর তৈরি করেছে। যাতে লোক বেশি হলেও সেখানে পরিবেশ থেকে শুরু করে নাগরিক সুবিধার কোনো সমস্যা নেই।

তার মতে, আমাদের সমস্যা হলো ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ মানুষ হওয়াতে তাদের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, রাস্তাঘাট, অতিরিক্ত গাড়ির চাপে ট্রাফিকব্যবস্থা, সবুজায়ন, খেলার মাঠ, পার্ক শিক্ষাব্যবস্থাসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা ভেঙে পড়েছে। এতে করে আমাদের প্রজন্ম স্থবির হয়ে বড় হচ্ছে। সে সাথে দূষণ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এর কারণ স্ট্র্যাকচার্ড এলাকার মধ্যে ২২ থেকে ৩০ শতাংশ রোড হতে হবে। কিন্তু আমাদেও রোড হলো ৬ শতাংশ। যার কারণে ট্রাফিক সমস্যা প্রকট। এ অবস্থায় অন্ডারগ্রাউন্ড বা উড়াল সেতু করলেও ট্রফিক সমস্যা সমাধানে তাতে কোনো কাজ হবে না।

এ ছাড়া সবুজায়ন থাকতে হবে ২৫ শতাংশ জায়গায়। সেই সাথে পর্যাপ্ত জলাধার নদীনালা, খালবিল। কিন্তু আমাদের যা ছিল তাও ধীরে ধীরে ভরাট করে নগরীর মধ্যে অপরিকল্পিভাবে নতুন নতুন বাণিজ্যিক ভবন, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এতে শব্দদূষণ পরিবেশ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন শহর থেকে মানুষ ঢাকায় এসে স্থায়ী হচ্ছে। তাদের আবাসনে রাজধানীতে প্রতি বছর উঁচু ভবন বাড়ার সাথে ঢাকার ওপর প্রতিদিন নতুন করে চাপ বাড়ছে। কারণ এসব বড় বড় একেকটি ভবনে একেকটা গ্রামের সমপরিমাণ লোক বাস করে। এতে করে ইতোমধ্যে পরিবেশ দূষণ, সয়েল লেন্ড পলিউশন, শব্দদূষণসহ নানা বিপর্যয় শুরু হয়েছে। এতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত ঢাকা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটা বিস্ফোরণোমুখ পরিস্থিতিতে পড়বে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে নগরী তার গতি কমেছে। মন্থর গতির কারণে মানুষ কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। তাতে অর্থনীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে আগামীতে এমন দিন আসবে যেখানে এ নগরীতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়বে।

এর সমাধানের বিষয়ে তিনি বলেন, এর মোকাবেলায় সমন্বিত আরবান প্ল্যানিং করতে হবে। এর মধ্যে আরবান প্ল্যানার, রিজোনাল প্ল্যানার, পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ প্রতিটি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এতে তাদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত বাস্তাবায়ন করতে পারলে কিছুটা হলেও তার সমাধান হবে।

রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকার দিকে মাইগ্রেশন রোধ করতে হবে। শিল্প স্থাপনা, ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল, গার্মেন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ অফিস স্থাপনাকে এগুলোকে পরিকল্পিতভাবে ঢাকার বাইরে ডিভিশন হেডকোয়ার্টার বা উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে এমন এলাকায় স্থানান্তর করতে হবে। তাতে করে মানুষ কমার সাথে নগরীর ওপর চাপ কমবে। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, সবুজায়ন বৃদ্ধি, নদী খনন, জলাশয় নদীনালা দখলমুক্ত করে তা রক্ষায় পদেক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাতে করে নাগরীকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে। পরিবেশ বিপর্যয় থেকে নগরী রক্ষা পাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো: খালিদ হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই এমনটা হয়েছে। যেকোনো পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে কেউ নিয়ম মানছে না। রাস্তায় অনেক ফিটনেস বিহীন গাড়ি কালো ধোঁয়া ছাড়চ্ছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক নেই। আসল কথা হলো এখানে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার এখন আর কিছুই আর নেই। এর প্রধান কারণ এ শহরের ধারণক্ষমতা আনেক আগেই অতিক্রম করেছে। ফলে অতিরিক্ত লোকের চাপে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় যদি জনগণ সরকার সবাই এগিয়ে না আসে তবে এর সমাধান সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে এ শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। তারপরও এ শহর রক্ষায় কোনো উদ্বেগ নেই। এমনটা বন্ধ না হলে কয়েক বছরের মধ্যে এ শহরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

অন্য দিকে বিরাজমান অবস্থায় কয়েক বছর পর ঢাকার কেমন অবস্থা হবে, এমন প্রশ্নে অনেকটা বিরক্তি প্রকাশ করেন নগরবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, এভাবে কমন গ্রাউন্ডে কথা বলার কোনো মানে নেই। আগামী পাঁচ বছর পর ঢাকার কী পরিস্থিতি হবে তা একজন রিকশাচালকও জানেন। এটা সহজ হিসাব যে এরকম চলতে থাকলে খারাপ হবে। আর প্রতিরোধ গড়ে তুললে ভালো হবে। তবে এ বক্তব্যের মধ্যে আপনার আমার কী অবদান রইল। তবে এর সমাধানে প্রতিটি ব্যক্তি, দল, সংগঠন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তিনি বলেন, আমি বিশ^াস করি সাংবাদিকতা এখন অন্যতর উচ্চতায় নেয়া প্রয়োজন। সেখানে আমরা নির্দিষ্ট বিষয়ে নির্দিষ্ট অ্যাপ্রোচ করব। এবং সেটার একটা সমাধান খুঁজব। আর এভাবে এসবের কোনো সমাধান হচ্ছে না উল্টো আমরা আপনারা ধ্বংসকারীদের অংশ হচ্ছি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/767435