৫ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ১:২৬

মুষলধারার বৃষ্টিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতা

ছুটির দিন শুক্রবার মুষলধারে বৃষ্টি ঝরেছে রাজধানীতে। এতে রাজধানীর বিভিন্নস্থানে দেখা দেয় পানিবদ্ধতা। তবে স্বস্তির কথা হলো- বৃষ্টিতে কয়েকদিনের ভ্যাপসা গরমের অবসান ঘটে। এর আগে সকাল থেকেই রাজধানীর আকাশ ছিল মেঘলা। পরে বৃষ্টি শুরু হলে কেটে যায় ভ্যাপসা গরমের প্রভাব। তবে জুমার নামাজের সময়েও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন মুসল্লিরা। এ সময় অনেককেই ছাতা মাথায় নিয়ে মসজিদে যেতে দেখা যায়। পরে নামায শেষেও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় আশপাশের বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলে আশ্রয় নেন মুসল্লিরা।

শুক্রবার সকালেই দেশের আট বিভাগের বেশকিছু অঞ্চলে বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিল আবহাওয়া অধিদফতর। সংস্থাটির সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে।

আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম জানান, উত্তর ছত্রিশগড় এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত মৌসুমী নি¤œচাপটি পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও দুর্বল হয়ে উত্তর ছত্রিশগড় এবং তৎসংলগ্ন উত্তরপূর্ব মধ্যপ্রদেশ-দক্ষিণপূর্ব উত্তর প্রদেশ এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপ হিসেবে অবস্থান করছে। এটি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে দুর্বল হয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে মৌসুমী বায়ুর অক্ষ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, সুস্পষ্ট লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। পাশাপাশি এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এছাড়া মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি থেকে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আবুল কালাম মল্লিক গতকাল বিকেলে বলেন, ৯ ঘণ্টায় শুক্রবার রাজধানীতে ৫১ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বেশি বৃষ্টি হয়েছে দুপুর ১২টার পর থেকে। এদিন সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়, ৭১ মিলিমিটার। এরপর সীতাকু-ে ৬৮ মিলিমিটার, ভোলায় ৪০, মাদারীপুরে ২৪ ও ফেনীতে ১৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে দেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাই মাসে। ওই মাসে এ বছর ৫১ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। গত বছর এ মাসে ৫৮ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল। গত জুলাই মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। তবে মাসের শেষ দিকে বৃষ্টি শুরু হয়। চলতি আগস্ট মাসের প্রথম দিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। দিন দিন বৃষ্টি বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর প্রতিদিন দেশের ৪৪টি স্টেশনের আবহাওয়ার বার্তা তুলে ধরে। গতকাল সকাল নয়টায় দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গা বাদ দিয়ে সব স্টেশনে বৃষ্টি হয়েছে।

পূর্বাভাসে বলা হয়, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, রংপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে।

চট্টগ্রাম ব্যুরো : গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত থেকে শুরু হওয়া টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম মহানগরীর বেশীরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমড় পানি ছিল। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল থাকায় পানি সরতে না পেরে অনেক ঘর ও দোকানপাটের ভেতর পানি ঢুকে গেছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী।

গতকাল শুক্রবার সকালে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, বর্ষার শেষভাগে এসে টানা বর্ষণে নগরীর বেশীরভাগ এলাকা পানিবদ্ধ হয়ে পড়ে। মূল সড়কের পাশাপাশি পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল নগরীর অলিগলিতেও। নিচতলার বাসাবাড়ি-দোকানপাটে ঢুকে পড়ে পানি। ড্রেনের পানি সড়কে উঠে আসে। খোদ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনও হাঁটু পানির নিচে তলিয়ে যায়। নগরীর বহদ্দারহাটে চসিক মেয়রের ব্যক্তিগত বাসভবনের সামনে হাঁটু পরিমাণ পানি দেখা গেছে। মেয়রের ব্যবহৃত চসিকের গাড়ি পানির মধ্যেই রাখা আছে। নগরী পানিতে ডুবলেও নিজেই পানিবন্দী হয়ে পড়ায় মেয়র সকালে বের হতে পারেননি বলে জানিয়েছেন বাসায় কর্তব্যরতরা।

এদিকে রাতভর বৃষ্টিতে শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, মেহেদীবাগ, ষোলশহর ২নম্বর গেট, কাপাসগোলা, চকবাজার, মোহরা, হামিদচর, চররাঙামাটিয়া, চান্দগাঁও, কাপ্তাইরাস্তারমাথা, খাজারোড, বাকলিয়ার বিভিন্ন এলাকা, মিয়াখাননগর, চাক্তাই, খাতুনগন্জ, আছদগন্জ, পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গিবাজারের একাংশ, পাচঁলাইশ, প্রর্বতক মোড়, কাতালগঞ্জ, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, কেবিআমানআলী রোড, চান্দগাঁওয়ের শমসেরপাড়া, ফরিদারপাড়া, খতিবেরহাট, বারইপাড়া, ঘাসিয়াপাড়া, পাঠাইন্যাগোদা, মুন্সীপুকুর পাড়, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর, ছোটপুল-বড়পুল, গোসাইলডাঙ্গা জুবিলী রোড তিন পুলের মাথা,রিয়াজউদ্দিন বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়কে ও অলিগলি পানিবদ্ধ হয়ে পড়ে। চকবাজার, রেয়াজউদ্দিন বাজার, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার দোকানপাট পানিতে তলিয়ে যায়। এতে পানিতে ভিজে মালামালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নগরীর মোমিন রোড চেরাগি পাহাড় সংলগ্ন নিচু আবাসিক এলাকা শরীফ কলোনিতে প্রায় বুকসমান পানি উঠে যায়। তিন পুলের মাথা এলাকার বাসিন্দারা জানান, রেয়াজউদ্দিন বাজারের প্রবেশপথে প্রায় এক কোমর পানি হয়েছে। এখানে ড্রেন বড় করে কালভার্ট বানানো হয়েছে। তারপরও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগে এত পানি উঠতে আমরা কখনও দেখিনি। শরীফ কলোনির বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, সকালে উঠে দেখি, বাসার সামনে এক হাঁটু পানি। আর রাস্তায় এক বুক পানি। সেটা দেখে আবার ঘরে ফিরে এসেছি। মিয়াখান নগর এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রাসেল খান বলেন, শেষরাতের দিকে বাসার ভেতর পানি ঢুকতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে পানি থইথই করতে থাকল। খাটের ওপর বিছানাপত্রও ভিজে গেল। সব চাক্তাই খালের নোংরা পানি। চকবাজার ওয়ার্ডের বাসিন্দারা জানান, চাক্তাই খালের কারণে চকবাজার ওয়ার্ডে দুর্ভোগ বেশী। এই ওয়ার্ডে প্রায় সব জায়গায় পানি উঠেছে। কাপাসগোলা আর মুন্সীপুকুর পাড়ে বেশি পানি উঠেছে। তবে সকাল ১১টার পর থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। কাপাসগোলা এলাকার বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, গতকাল রাত থেকে তার ঘর হাঁটুপানিতে ডুবে আছে। জিনিসপত্র সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পানি না সরায় ঘরের পানি বাইরে বের করা যাচ্ছে না।
চান্দগাঁও ওয়ার্ডের ফরিদার পাড়া, শমসের পাড়া, পাঠাইন্যাগোদা, বহদ্দারহাট এলাকায় কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও আবার তারচেয়েও বেশি হয়েছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে চলমান জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে নগরীর ৫৭টি খালের মধ্যে ৩৬টির কাজ চলছে। বাকি ২১টি খালে পানি যাওয়ার পথ নেই। এসব খাল ও বিভিন্ন পয়েন্টের ব্রিজ, কালভার্টে বিদ্যুৎ, ওয়াসা ও গ্যাসের লাইনে ময়লা জমে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় ভারি বর্ষণের সতর্কবাণী দেয়া হয়েছে। এসময় ভূমিধসের আশঙ্কা আছে। এছাড়া সমুদ্র বন্দরগুলোকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা এবং নদীবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় মাঝারি থেকে ভারি ধরনের বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। শুক্রবার বেলা ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মাঝারি থেকে ভারি ধরনের বৃষ্টিপাত আরও দুই-তিনদিন অব্যাহত থাকতে পারে।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছে, এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় চাক্তাই খালের মাটি পুরোপুরি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) পুরোপুরি অপসারণ না করায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় উঠে যাওয়া পানি দ্রুত অপসারণের জন্য মেয়র মহোদয় বিভিন্ন নির্দেশনা আমাদের দিচ্ছেন। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। সিডিএ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। একটি প্রকল্পও নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেনি সংস্থাগুলো। বারবার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এ নিয়ে নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধানে গত বছর চার সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটিতে প্রধান করা হয়েছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে। ওই কমিটি জলাবদ্ধতার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো অতিবর্ষণ ও কর্ণফুলী নদীতে পূর্ণিমার সময় অতিরিক্ত জোয়ার, খালের পরিধি কমে আসা, নগরের খাল ও নালা-নর্দমা বেদখল, অসচেতনতার কারণে খাল-নালায় বর্জ্য ফেলা এবং নিয়মিত খাল-নালা থেকে মাটি উত্তোলন না করা।

এদিকে চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি টিম এসে সড়ক থেকে মাটি সরিয়ে নিলে যানচলাচল স্বাভাবিক হয়।শুক্রবার সকালে নগরীর টাইগারপাসে এ ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ছুটির দিন ও বৃষ্টির কারণে সড়কে যানবাহন কম ছিল। সকালে পাহাড়ের একটি অংশ ধসে গাড়ির ওপর পড়ে। চালক ছিটকে বাইরে পড়ে যান। তবে কোনো ক্ষতি হয়নি।

https://dailysangram.info/post/531799