৫ আগস্ট ২০২৩, শনিবার, ১:২৩

জাতির অনিশ্চিত গন্তব্য

-ইবনে নূরুল হুদা

একশ্রেণির ক্ষমতালিপ্সু, অদূরদর্শী ও আদর্শহীন রাজনীতিকের কারণেই শুধু আমাদের রাজনীতি নয় বরং জাতির গন্তব্যই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মূলত, এরাই আমাদের দেশের গণমুখী রাজনীতির কক্ষচ্যুতি ঘটিয়েছেন। ফলে আমাদের দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ হারাতে শুরু করেছেন। এমনকি নির্বাচন নিয়ে তার আগ্রহটা একেবারে তলানীতে এসে ঠেকেছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি সেদিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নাগরিকরা রাজনীতি ও রাষ্ট্রের কল্যাণ থেকে প্রায় ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হচ্ছেন। নাগরিকরা রাষ্ট্রের ব্যয় নির্বাহের যথারীতি কর প্রদান করলেও রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি, কর্তব্য ও দায়িত্ব মোতাবেক নাগরিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। বিশেষভাবে গত প্রায় দেড় দশকে দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনগুলো হয়ে উঠেছে রীতিমত চরদখলের মত। রাজনীতি সেবামূলক কাজ এবং রাজনৈতিক সংগঠন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হলেও আমাদের দেশের ক্ষয়িষ্ণু ও নেতিবাচক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এসব একশ্রেণির মানুষের ক্ষুদ্রস্বার্থ, আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসলেও তাদের এই দাবি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোন মহলেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বরং বিষয়টিকে ক্ষমতাসীন মিথ্যাচারের বেসাতি হিসাবেই মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। যা জাতি হিসাবে আমাদের গন্তব্যকেই অনিশ্চিত করে তুলেছে। তারপর অবৈধ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ একশ্রেণির রাজনীতিকের পিছু ছাড়ছে না।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে কিছু হলেও নড়েচড়ে বসেছে। বিগত ২টি নির্বাচন মহল বিশেষে বিতর্কিত বলা হলেও বিরোধীদলগুলো নির্বাচনগুলোকে তামাশা ও ভাঁওতাবাজির নির্বাচন বলে আখ্যা দিয়ে আসছে। তাই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সকল মহল থেকেই আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার এই যৌক্তিক দাবিকে নানাভাবেই পাশ কাটিয়ে এসেছে। এমনকি বিষয়টিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেও এড়িয়ে গেছে। কিন্তু এবার সরকার এসব বলে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে বল মনে হচ্ছে না বরং এখন লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তারা এখন ‘শ্যাম রাখি, না কূল রাখি’ এমন অবস্থায় পড়েছে।

আমাদের বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ও উন্নয়ন সহযোগিরা দীর্ঘদিন থেকে দেশে একটি অবাধ নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে আসলে সরকার বিষয়টি থোড়াই কেয়ার করেছে। কারণ, তারা ধরেই নিয়েছে যে, দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে তাদের আখেরাত খুব একটা ভাল হবে না। এমন কথা ওঠে এসেছে সরকার সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যক্তির পক্ষ থেকেও। এতে সরকার পক্ষ খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। কারণ, তারা বরাবরই দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দেশীয় আন্তর্জাতিক মহলকে আশ্বস্ত করলেও তাদের এই প্রতিশ্রুতিকে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেনি। ফলে সরকার সম্পর্কে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্টদের মোহভঙ্গ ঘটেছে বলেই মনে হচ্ছে। প্রসঙ্গত, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে পর্দার আড়ালে যে, কূটনীতি এক বছর ধরে চলছে; জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্দার আড়ালে কূটনৈতিক পর্যায়ে দূতিয়ালি করছে; এখন সেই দূতিয়ালি কার্যত প্রকাশ্যে চলে এসেছে। আর হয়েছে মহল বিশেষের একগুঁয়েমীর কারণেই। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকা সফরে আসা প্রতিনিধি এবং ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা এবং প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এবং বিদেশীরা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে তা বিশ্বাস করেছেন; সেই বিশ্বাসে কার্যত এখন বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। ২৯ জুলাই বিএনপির ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি নিয়ে যে সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাত ঘটেছে এবং এটা নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা যে একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাসের মোহভঙ্গ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে এতদিন পর্দার আড়ালে থেকে চাপ দেয়া এবং দূতিয়ালি করলেও সেটা কার্যত প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছেন। যা জাতি হিসাবে আমাদের মানমর্যাদা ক্ষুণœ করেছে। আর এমনটি হয়েছে ক্ষমতাসীনদের অতিমাত্রায় ক্ষমতালিপ্সার কারণেই।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীনরা প্রতিশ্রুতির দিয়ে বলেছিল, এটা সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। ভোটের ৬ মাসের মধ্যে ফের নির্বাচন দেয়া হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব বিদেশী শক্তি তা বিশ্বাস করেছিল। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির দেয়া হয়। সংলাপের আয়োজন করা হয়। কিন্তু বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বাধ্য করবে। কিন্তু দেশটি সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একতরফাভাবে সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে দেশটি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করায় এবার তাদের দূরে সরিয়ে রেখেই যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। যা দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে। যদিও তা একটি স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র রক্ষা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, উগান্ডা, সোমালিয়ায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা সেটা করবে না। তবে নির্বাচনের আগেই নিষেধাজ্ঞা দিতে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে বলেই অভিজ্ঞমহল মনে করছে। যদি সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো কিছু করার চেষ্টা করে তাহলে ১৪ কংগ্রেসমানের চিঠি কার্যকর হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন তারা। আর এমনটির যৌক্তিকতাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উজরা জেয়া ও ডোনাল্ড লু’কে অবাধ, সুষ্ঠু এবং সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে। শুধু তাই নয়, বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলকে সভাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে করতে দেয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। উজারা জেয়া ঢাকা ত্যাগের আগে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকেও তারা এ প্রতিশ্রুতি দেন। এমনকি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বিঘেœ সভাসমাবেশ করতে পারবে এমন নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। উজরা জেয়া ঢাকায় অবস্থানকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হয়েছে। এতে তিনি দুই দলের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু তিনি এবং তার দল ঢাকা ত্যাগের পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে গেছে। ২৯ জুলাই ঢাকার কয়েকটি স্থানে বিএনপি নেতাদের ওপর পুলিশের নির্যাতন, পুলিশ এবং হেলমেট বাহিনী মিলে বিএনপির নেতাদের বিতাড়িত করা এবং অবস্থান কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের সচিত্র প্রতিবেদন দেশী ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। ভয়াবহ এ দৃশ্য দেখে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি ১ আগস্ট জামায়াত আহুত সমাবেশও তাদের করতে দেয়া হয়নি।

যুক্তরাষ্টের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার প্রায়ই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুলে ধরেন। কিন্তু গত এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতির বিষয় সেখানে খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রায়ই বাংলাদেশের নির্বাচন, মানবাধিকার, আইনের শাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এসব খবর আল-জাজিরা, বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রচার করে। বিশ্বের গণমাধ্যম জগতে রয়টার্স অতিবিশ্বসযোগ্য গণমাধ্যম। সেই রয়টার্স ঢাকার রাজপথে বিএনপির নেতাকে রক্তাক্ত করার ঘটনায় বাংলাদেশে রাজনীতি, নির্বাচন নিয়ে তৎপর্যপূর্ণ খবর প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের সংবাদ সম্মেলনের খবরও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমটি প্রচার করেছে গুরুত্বসহকারে।

উজরা জেয়াকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ এবং বাধাহীনভাবে সমাবেশ বিক্ষোভ করার প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা দেয়ার পরও বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে পুলিশ ও হেলমেট বাহিনীর তা-ব, রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ায় রক্তারক্তি অবস্থায় সৃষ্টি করার প্রতিবাদ জানিয়ে জাতিসংঘ বলেছে, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উৎসাহিত করে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, কোনোভাবেই সংঘাত-সংঘর্ষ কাম্য নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

ব্রিটেনভিত্তিক ওই মানবাধিকার সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়, কোনো অবস্থাতেই বিক্ষোভ সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে আগ্নেয়াস্ত্র ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা যাবে না। গুটিকয়েক মানুষের সহিংস আচরণে এমন প্রতিক্রিয়া দেখানো যাবে না, যাতে পুরো বিক্ষোভ ‘সহিংস’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর আগে গত মাসে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসের ১৪ সদস্য। একই সঙ্গে তারা জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের সদস্যপদ স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এসব বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তারা জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ডকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠি পাঠানোর পর রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য বব গুড এক টুইট বার্তায় (বর্তমান এক্স) বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অধিকার রয়েছে। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর বাংলাদেশ সরকারের সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে আমি ও আমার ১৩ সহকর্মী জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছি।’

রাজনীতি সচেতনরা বলছেন, রাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর সঙ্কট অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সরকারের অতিমাত্রায় ক্ষমতার লোভ, রাষ্ট্রের ভয়াবহ সঙ্কট উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই সরকারের অগণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতি অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্র উঁচু মাত্রার ঝুঁকিতে পড়বে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের সদস্যপদ স্থগিত রাখাসহ ৩ দফা দাবিতে-জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে দেয়া ১৪ কংগ্রেসম্যানের চিঠি মূলত, সরকারের অপশাসনের কারণে দেয়া হয়েছে।

জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ডকে ১৪ কংগ্রেসম্যানের চিঠি দেয়া বাংলাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর অশনি সঙ্কেত মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে প্রশাসনিক সব সিদ্ধান্ত ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু সেটা নয়। সেখানে নীচ থেকে প্রস্তাব আসে পরে দায়িত্বশীলরা তা পাস করেন। যে ১৪ কংগ্রেসমান চিঠি দিয়েছেন তারা কেউ জো বাইডেনের দলের নয়। সবাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান। তারা যে প্রস্তাব করেছেন সে প্রস্তাব উপরে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যত্যয় ঘটানোর চেষ্টা হলে ১৪ কংগ্রেসম্যান যে দাবি করেছেন তার সবগুলোই কার্যকর করা হবে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যা চায় জাতিসংঘ তার বাইরে যেতে পারবে না। এটা আমাদের জন্য সমূহ বিপদ। শুধু তাই নয় বাংলাদেশে তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্র ক্রয় বন্ধ করলে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া সব দেশ তা বন্ধ করে দেবে। তখন ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়বে দেশ। কিন্তু এসব বিষয় ক্ষমতাসীনরা কোনভাবেই আমলে নিচ্ছে না।

উজারা জেয়াকে প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও রাজপথে বিএনপির নেতাদের রক্তাক্ত করার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলকে নাড়া দিয়েছে। তারা সরকারের প্রতিশ্রুতির ওপর আর ভরসা পাচ্ছেন না। তাদের শঙ্কা ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকার থেকে যে প্রতিশ্রুতির আন্তর্জাতিক মহলকে দেয়া হয়েছিল তা রাখা হয়নি। এবারও সেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিনিধি দলের আদলে বিদেশ থেকে হায়ার করে এনজিওর প্রতিনিধি দল এসে সরকারের পক্ষে ওকালতি করানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ইচ্ছামতো বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা কোন শুভ ইঙ্গিত বহন করে না।

সম্প্রতি ঢাকায় নিয্ক্তু মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে নির্বাচন ইস্যুতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠক থেকে বের হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল তার আগের অবস্থান থেকে অনেকটা সরে গিয়ে বলেছেন, চলমান সঙ্কট নিরসনের রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপের আয়োজন করা উচিত।
পিটার হাস বলেছেন, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ, নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম দেখতে আগামী অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-পর্যালোচনা নির্বাচনী টিম ঢাকা আসবে। যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকায় যারা আসবেন সেই প্রাক পর্যালোচনা (প্রি-অ্যাসেসমেন্ট) নির্বাচনী দলে থাকবে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউট এবং ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউটের বিশেষজ্ঞরা। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তুতি নিয়ে যাদের অগাধ অভিজ্ঞতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরেপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়। যাতে বাংলাদেশের জনগণ সরাসরি ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে দেয়া যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১২ দেশের বিবৃতিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ‘ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন’ অভিহিত করে যে বক্তব্য দিয়েছেন; সেটাকে অগ্রাহ্য করেছেন। পিটার হাস বলেন, ওই বিবৃতিতে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন হয়নি। বরং অন্য দেশগুলো যখন আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক বিষয় উত্থাপন করেন, তখন আমরা তাদের কথা শুনি, বোঝার চেষ্টা করি। আমরা দেখি তাদের কাছে কী শেখার আছে। আমরা এটাকে ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন মনে করি না। তবে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে পিটার হাস পশ্চিমা কূটনীতির মারপ্যাঁচে নির্বাচন কমিশনকে কী বার্তা দিলেন?

সার্বিক দিক বিবেচনায় মনে হচ্ছে, সরকার তাদের তৈরি করা গর্তেই পড়তে যাচ্ছে। কারণ, এখন দেশে যে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা বর্তমান সরকারের দুই হাতের কামাই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকার কেয়ারটেকার সরকারের দাবি পাশ কাটানোর জন্য বিদেশী কূটনীতিকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দরকার তা করতে পারছে না। ফলে আন্তর্জাতিক মহল বর্তমান সরকারের ওপর পুরোপুরি আস্থাহীন। আর এই আস্থাহীনতা থেকেই আন্তর্জাতিক মহল এখন বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যেই মাঠে নেমেছে। যদিও তা আমাদের জন্য মোটেই সুখকর নয়।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশে নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ পর্যালোচনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগাম পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে সরকারকে অনেকটা বেকফুটে ফেলে দিয়েছে। তাই সরকারের উচিত সঙ্কীর্ণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা। যেহেতু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলীয় সরকারের অধীনে বিশ^াসযোগ্য নির্বাচনের কোন রেকর্ড নেই, তাই নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারও অন্যতম অনুষঙ্গ। মনে রাখতে হবে নির্বাচন শুধু সরকার পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হলে হবে না বরং সকল অংশীজনের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তাই দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই নির্বাচন বিষয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হওয়ার দরকার। অন্যথায় জাতি হিসাবে আমাদের গন্তব্যই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর এর দায় ক্ষমতাসীনরা কোনভাবেই এড়াতে পারে না।

https://dailysangram.info/post/531765