৪ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবার, ১:২১

দালালের দৌরাত্ম্য, ঘুষ নেন আনসারও

‘কী লাগবে? জমা দেবেন, নাকি নেবেন? নতুন, নাকি রিনিউ করবেন?’ অভিন্ন ভাষায় এমন কথা বলতে বলতে দু’জন ঘিরে ধরলেন। তারা যে পাসপোর্ট অফিসের দালাল– বুঝতে বাকি রইল না। তারা আরও কী বলতে চান, তা জানার জন্য নতুন পাসপোর্ট করার পদ্ধতি জিজ্ঞাসা করা হলো। নিজের নাম জাহিদ জানিয়ে একজন দালাল জানালেন, ফরম পূরণ থেকে শুরু করে অনলাইনে আবেদন তিনি করে দেবেন। ছবি ও ফিঙ্গার দিতেও ঘুরতে হবে না, এক দিনের মধ্যেই সব কাজ করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। দাঁড়াতে হবে না লাইনে। এসব করতে সরকারি ফি বাদে অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা দিতে হবে তাকে।

লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলার বিষয়টি কীভাবে ব্যবস্থা করবেন– প্রশ্ন করলে বললেন, ‘চ্যানেল আছে। চ্যানেলে কাজ হয়ে যাবে। এসব নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না।’ এই দৃশ্য ও কথোপকথন আগারগাঁওয়ে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের সামনের ফুটপাতে গত সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে।

দেখা গেল, পাসপোর্ট অফিস চত্বরে কেউ পা রাখামাত্র ঘিরে ধরে দালালরা। পাসপোর্ট ভবনের প্রবেশপথে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সামনেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে কাজ করছে দালাল চক্র। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে অনেক দালাল। জামিনে বেরিয়ে একই পেশায় ফেরে তারা।

গত সোম ও মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, পাসপোর্ট ভবনের গেটের সামনে দালালমুক্ত সাইনবোর্ড সাঁটানো আছে। অথচ সাইনবোর্ডের পাশে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সামনেই গ্রাহকের পথ আগলে দালালদের দেনদরবার করতে দেখা যায়। পাসপোর্ট ভবন সংলগ্ন রাস্তার পাশেই মানুষের বসার ছাউনি রয়েছে। দালালের ভিড়ে সাধারণ মানুষের সেখানে বসার অবস্থা থাকে না।

সোমবার দুপুর ১টা ৭ মিনিট। পাসপোর্ট ভবনের ২ নম্বর গেটের আনুমানিক ১০ গজ ভেতরে নিচতলার এক কোনায় এক তরুণ ও এক আনসার সদস্যকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরই ওই তরুণ সেই আনসার সদস্যের হাতে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আনসার সদস্য এদিক ওদিক তাকিয়ে টাকা গ্রহণ না করে বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। গেলেন ভবন সংলগ্ন সড়কের পাশে শরবত বিক্রির ভ্যান গাড়ির কাছে। তার সঙ্গে ওই তরুণের পাশাপাশি আরও তিন স্বজন গিয়ে দাঁড়ালেন সেখানে। এক ফাঁকে আনসার সদস্যের প্যান্টের পকেটে ওই তরুণ টাকা ঢুকিয়ে দিলেন। আনসার সদস্যের নাম রানা মিয়া। টাকাটা পেয়ে তিনি সড়কের পশ্চিম দিকে চলে গেলেন।
ওই তরুণ জানালেন, তাদের বাসা শাহবাগ এলাকায়। গেল কোরবানি ঈদের আগে তাঁর আত্মীয় আমিন উদ্দিন পাসপোর্টের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলেন। সোমবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি দেওয়ার জন্য এসেছিলেন আমিন। সঙ্গে তারাও এসেছেন। লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াই ওই আনসার সদস্য ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি উঠানোর ব্যবস্থা করে দেন আমিনকে। এ জন্য ৫০০ টাকা দাবি করেছিলেন তিনি। কিন্তু সিসি ক্যামেরা থাকায় অফিসের মধ্যে টাকা নিচ্ছিলেন না। তাই বাইরে এসে টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, ফিরে এসে ফের দায়িত্ব পালন করছেন রানা মিয়া।

ঢাকার খিলক্ষেত এলাকার এক তরুণ সোমবার পাসপোর্ট ভবনে যান পাসপোর্টে নামের বানান ভুল সংশোধন করতে। এ জন্য দালাল ধরেছেন তিনি। দালালকে অতিরিক্ত ছয় হাজার টাকা দিতে হয়েছে। নিজের নাম প্রকাশ করতে চাননি তিনি।

মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে পাসপোর্ট ভবনের চারতলায় কথা হয় আবদুর রহমান নামে এক যুবকের সঙ্গে। বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলেন, তাঁর এক আত্মীয় পাসপোর্ট নবায়ন (রিনিউ) করতে এসেছেন। ই-পাসপোর্ট করবেন। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি উঠানোর জন্য এসেছেন। সোমবার এসেছিলেন তারা। দালালের মাধ্যমে ফরম পূরণসহ যাবতীয় কাজ সেরেছেন। ওইদিনই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি উঠানোর কথা ছিল; কিন্তু পুরোনো দ্বিতীয় পাসপোর্ট সঙ্গে না থাকায় মঙ্গলবার আসতে হয়েছে। দালালকে এক হাজার টাকা দিয়েছেন। ফলে দ্রুত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলার ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দালাল না ধরলে ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়ার তারিখ পেতে সময় লাগে।’

মঙ্গলবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে পাসপোর্ট ভবনের নিচতলায় ১০১ নম্বর কাউন্টারের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে কথা হয় লিটন মিয়া নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। বসে থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলেন, তাঁর পাসপোর্টে ও জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) নাম ও জন্ম তারিখ দু’ভাবে আছে। তা সংশোধনের জন্য এসেছেন। এ কাজে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছেন একজন দালালকে। দালালের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

দালালের মাধ্যমে কেন এ কাজ করছেন– জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘কে দৌড়াদৌড়ি করে! কে ঝামেলা করে, ব্যবসা-বাণিজ্য ফেলে।’
এর আগে সকাল ১১টার দিকে ওই বেঞ্চে বসে কথা হয় আবদুর রহিম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি জানালেন, পাসপোর্ট রিনিউ করতে এসেছেন। এক আনসার সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। কথা বলার সময় ১১টা ১৮ মিনিটে মথিষ নামে এক আনসার সদস্য রহিমসহ তিনজনের পাসপোর্ট নিয়ে অফিসের ভেতরে যান। পরে জানা গেল, মথিষ আনসার প্লাটুন কমান্ডার। তিনি পাসপোর্ট অধিদপ্তরে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন।

কিছু আনসার সদস্যের সেবা গ্রহণকারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের আনসার প্লাটুন কমান্ডার রেজাউল ইসলাম বলেন, অফিসারদের কক্ষে আনসার সদস্যদের প্রবেশ নিষেধ আছে। কোনো আনসার সদস্য টাকা নিলে এবং সেটা প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অফিসের সামনে দালাল অবস্থানের বিষয়ে তিনি জানান, তাদের দায়িত্ব প্রবেশপথ এবং অফিস ভবনে। বাইরে দালাল দেখার বিষয় তাদের না। তবে প্রবেশপথের সামনে দালাল এলে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন সমকালকে বলেন, এক সময় অফিসে মানুষের ভিড় থাকত। এখন ভিড় কম। বসার জায়গা আছে। অনলাইনে সব কার্যক্রম সহজেই করা হয়। মানুষ চমৎকার সেবা পাচ্ছে। মানুষ সরাসরি অফিসে আসবে, দালালের কাছে কেন যাবে? রাস্তায় দালাল কাউকে হয়রানি করার চেষ্টা করলে পুলিশকে জানানোর আহ্বান জানান তিনি।

https://samakal.com/capital/article/2308187515