৪ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবার, ১:১৯

আ’লীগের উপকমিটিতে সরকারি কর্মকর্তারা

আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক উপকমিটিতে বিসিএস ক্যাডারসহ অন্তত পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তা পদ পেয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, এটি চাকরিবিধির গুরুতর লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে পদ পাওয়া কর্মকর্তারা বলছেন, দোষের কিছু নেই। দল তাদের যোগ্য মনে করে পদ দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, এতে সমস্যা নেই।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের স্বাক্ষরে ৭৮ সদস্যের উপকমিটি গত ৮ জুলাই অনুমোদন হয়। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক উপকমিটির চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা উপকমিটির সদস্য সচিব।

উপকমিটির ১৫ নম্বর সদস্য অধ্যাপক ডা. কামরুল মিলন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব। স্বাস্থ্য ক্যাডারের এই কর্মকর্তা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।’

বিধিমালায় স্পষ্ট বিধিনিষেধ থাকলেও আরও কয়েকজন শাসক দলের উপকমিটিতে পদ পেয়েছেন। ১৬ নম্বর সদস্য ডা. সেলিম আক্তার চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। ৩৬ নম্বর সদস্য ডা. জহিরুল ইসলাম লিটন ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি স্বাচিপের শিশু হাসপাতাল শাখার সাধারণ সম্পাদক। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রণীত বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল এবং ইনস্টিটিউট আইনে চলে হাসপাতালটি। এই আইনে এখানকার চিকিৎসক, কর্মকর্তাদের জন্যও সরকারি চাকরি বিধিমালা প্রযোজ্য বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সরকারি কর্মকর্তাদের আওয়ামী লীগের কমিটিতে পদ দেওয়ার বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেছেন, ‘এটা হতে পারে না। সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারা রাজনীতি করতে পারেন না। কমিটিতে থাকতেই পারেন না।

অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উপকমিটির ৪৫ নম্বর সদস্য ডা. শাহ তাহমিনা সিদ্দিকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নাজিরা বাজার মাতৃসদন কেন্দ্রের চিকিৎসক। ৭৭ নম্বর সদস্য ডা. রাকিব মুন্না জাতীয় পুষ্টিসেবার জেলা প্রশিক্ষক। তিনি প্রকল্পে কর্মরত। সরকারি বেতনভোগী হওয়ায় তিনিও রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেন না। রাকিব মুন্নার বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। জাতীয় পুষ্টিসেবার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান তাঁর অধীনস্থের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করেননি।

৪৮ নম্বর সদস্য ডা. আহমেদুল হাসান খান জাতীয় যক্ষ্মা রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। তিনি কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তাঁর জন্য সরকারি চাকরিবিধি প্রযোজ্য হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। উপকমিটির ৫৭ নম্বর সদস্য হিসেবে ডা. রথীন্দ্রনাথ সরকারের নাম রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত রথীন্দ্রনাথ সরকার স্বাচিপের সহআপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য রাজনীতিতে যুক্ত হতে বাধা না থাকলেও কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এ সুযোগ নেই। এ কারণে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সিলেট-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী তাহসিনা রুশদীর লুনার প্রার্থিতা বাতিল করেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার ছিলেন।

আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে পদ পাওয়া বেশির ভাগই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্বাস্থ্য ক্যাডার এবং সরকারি কর্মকর্তাদের পদ দেওয়ার বিষয়ে সাবেক সচিব মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সমকালকে বলেছেন, এটি চাকরিবিধির লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আওয়ামী লীগের বা অন্য কোনো দলের কমিটিতে বা উপকমিটিতে সরকারি চাকরিজীবীর পদ পাওয়ার সুযোগ নেই। স্থানীয় বা কেন্দ্রীয় কোনো পর্যায়ের কমিটিতেই থাকতে পারবে না।

তবে অধ্যাপক কামরুল হাসান মিলন পদ পাওয়ায় ‘দোষের’ কিছু দেখছেন না। তিনি সমকালকে বলেছেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বাচিপের মহাসচিব। একটি পদেও তো রয়েছি। আরেকটি কমিটিতে রেখেছে। এতে দোষের কী আছে।’
কামরুল হাসান মিলন এ দাবি করলেও স্বাচিপ আদতে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন নয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২৫(২) ধারা অনুযায়ী, মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ ও যুব মহিলা লীগ সহযোগী সংগঠন বলে গণ্য হবে। শ্রমিক লীগ এবং ছাত্রলীগ তাদের নিজ নিজ গঠনতন্ত্রে পরিচালিত হবে।

একাধিক চিকিৎসক জানান, ১৯৯৩ সালে গঠিত স্বাচিপ আওয়ামী লীগ সমর্থক ডাক্তারদের সংগঠন হলেও দলটির সহযোগী বা অঙ্গসংগঠন নয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বাচিপের সম্পর্ক অনানুষ্ঠানিক। কাগজপত্রে কোনো সম্পর্ক নেই। তাই সরকারি চিকিৎসকরা স্বাচিপের সদস্য হতে পারেন। কিন্তু কয়েক বছরে স্বাচিপ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। অনেকে ধারণা করছেন, স্বাচিপ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। স্বাচিপ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন নয়, জানানোর পর কামরুল হাসান মিলন সমকালকে বলেছেন, ‘তাহলে তো আর কিছু বলার নেই। তবে আমাকে আরেকটু জানতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা পাল্টা প্রশ্ন করেন, স্বাচিপের মহাসচিব উপকমিটিতে থাকলে সমস্যা কোথায়? এতে সরকারি চাকরিবিধির গুরুতর লঙ্ঘন হয় জানানো হলে তিনি বলেন, ‘কামরুল হাসানকে স্বাচিপের মহাসচিব হিসেবে পদাধিকার বলে রাখা হয়েছে। এখানে আর অন্য কিছু নেই।’

অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের পদ দেওয়ার বিষয়ে রোকেয়া সুলতানা বলেছেন, ‘সেলিম আক্তার চৌধুরীর কথা বলা হচ্ছে। তিনি আসলে সরকারি চাকরি করেন না। তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে চুক্তিতে চাকরি করছেন।’ সিটি করপোরেশন আইনে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাই রাজনীতিতে যুক্ত পারেন না– এ তথ্য জানানোর পর তিনি বলেন, ‘আমি দেশের বাইরে। ফিরে এসে বিস্তারিত আলাপ করব।’
পদ পাওয়া সরকারি কর্মকর্তারা ফেসবুক প্রোফাইলে এ খবর জানাচ্ছেন। সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাতের ছবি দিচ্ছেন। পদ প্রাপ্তির জন্য তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে স্ট্যাটাস আপডেট করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান সমকালকে বলেছেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সরকারি কর্মকর্তারা এখন আর ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়াকে অপরাধ মনে করেন না। এ কারণেই নিয়ম-শৃঙ্খলা এতটা ভেঙে পড়েছে। ফেসবুকে পদ পাওয়ার খবর নিজেই ছড়াচ্ছেন। এর জন্য তাদের যে শাস্তি পাওয়া উচিত– এ ভয় করছেন না। যাদের শাস্তি দেওয়ার কথা, তারাই প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

https://samakal.com/politics/article/2308187518