যমুনেশ্বরীর ডাঙ্গারহাট সেতু এলাকায় চর ড্রেজিং প্রকল্পের নামে শ্যালো মেশিন দিয়ে বালু তুলে বিক্রি : নয়া দিগন্ত
২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১:৪৪

যমুনেশ্বরী, চিকলী ও চারালকাটা নদীর ড্রেজিংয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি

৫৮২ কোটি টাকার কাজে চলছে হরিলুট

নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ এবং রংপুরের তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনেশ্বরী, চিকলী ও চারালকাটা নদীর চর ড্রেজিংয়ের নামে চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৫৮২ কোটি টাকা ব্যয়ের এ কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই চলছে হরিলুট। মানা হচ্ছে না শিডিউল। শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে বালু তুলে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কিছু ব্যক্তিকে প্রকল্প এলাকায় খবরদারির দায়িত্ব দিয়ে এলাকাবাসীর উঠতি ফসলও নষ্ট করা হচ্ছে। ফলে এ প্রকল্পের কোনো সুফলই পাবে না এলাকাবাসী।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে প্রকাশ, নীলফামারী ও রংপুর জেলাধীন কিশোরগঞ্জ, তারাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ উপজেলার যমুনেশ্বরী, চিকলী ও চারালকাটা নদীর চর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ ও তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজের জন্য পাঁচ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের যমুনেশ্বরীর নদীর বাহাগিলী ডাঙ্গার হাট বেইলি ব্রিজ এলাকায় ১০০ মিটার, চারালকাটা নদীর নিতাই পানিয়াল পুকুর এলাকায় ৭৫০ মিটার, রংপুরের তারাগঞ্জের যমুনেশ্বরী নদীর জয়বাংলা রহিমাপুর এলাকায় ৭৫০ মিটার এবং বদরগঞ্জের যমুনেশ্বরী নদীর মাধাই খামার এলাকায় ১০০ মিটার চর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ ও সংরক্ষণ করার কথা। এ জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হলে কাজটির ওয়ার্ক অর্ডার পায় নৌবাহিনীর ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড। তারা কাজটি বাস্তবায়নের জন্য ঢাকার ধানমন্ডির রুপু ট্রেডিং হাউজের মালিক মো: নাজমুল হকের কাছে ন্যস্ত করেন। তিনি কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি এমদাদুল হক, সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম, বালু ব্যবসায়ী গোপাল ও মামুন শাহকে প্রতি সিএফটি ১ টাকা ৪০ পয়সা দরে চর ড্রেজিংয়ের দায়িত্ব দেন। ওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী কাজটি ২২ মার্চ শুরু হয়ে ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা।
সরেজমিন বুধ ও বৃহস্পতিবার প্রকল্পের কিশোরগঞ্জের বাহাগিলী ইউনিয়নের ডাঙ্গারহাট ব্রিজ প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, চর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণের নামে চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি। প্রকল্প এলাকায় একটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ছিন্নভিন্ন ব্যানার টাঙানো থাকলেও তাতে শুধু লেখা আছে প্রকল্পের নাম। শিডিউল অনুযায়ী বরাদ্দসহ প্রয়োজনীয় কোনো তথ্যই সেখানে উল্লেখ নেই। বাতাসে দুলে দুলে ব্যানারটি নষ্ট হওয়ার পথে। শিডিউল অনুযায়ী খুঁটি দিয়ে প্রকল্প এলাকাতে সাইনবোর্ড টাঙানো থাকার কথা থাকলেও কোথাও তা চোখে পড়ে নি। এ দিকে প্রকল্প এলাকায় ১৭টি শ্যালো মেশিন দিয়ে চলছে বালু উত্তোলন। কোনো ড্রেজার মেশিন চোখে পড়েনি সেখানে। সেখানকার স্টিল ব্রিজের পাশেই বসানো হয়েছে শ্যালো মেশিন। এতে ব্রিজটি হুমকির মুখে পড়েছে। সেখান থেকে বালু উত্তোলন করে অনেকেই বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ নিজের দোলা জমি ভরাট করছেন।
ডাঙ্গারহাট বেইলি ব্রিজের পূর্ব পাশের বাঁধের ওপর কথা হয় বালু উত্তোলনকারী স্থানীয় সন্ন্যাসী পাড়ার বাসিন্দা যুগল চন্দ্র রায়ের সাথে। তিনি জানান, এক টাকা ৪০ পয়সা সিএফটি দরে আমি মামুন শাহ ও গোপালের কাছ থেকে ১৫০ মিটারের চর ড্রেজিংয়ের কাজ নিয়েছি। শ্যালো মেশিন দিয়েই বালু উত্তোলন করছি। আমার কাজ প্রায় শেষের পথে। আমি ২০ টাকা ট্রলি দরে (ছোট) ওই বালু বিক্রি করছি। শিডিউলে বালু বিক্রির বিধান না থাকলেও কেন বালু বিক্রি করছেন এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি। এ দিকে যুগল সেখান থেকে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন পাশের তারাগঞ্জ উপজেলার অধীর কুমার দত্তের ছেলে অর্পণ দত্তের কাছে। প্রতিদিন ২০টি ট্রলি দিয়ে তারাগঞ্জ থানা ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে এসব বালুর ট্রলি যাচ্ছে অর্পণ দত্তের জমিতে।
রোমাস পরিবহন ট্রলির ড্রাইভার জাহিদুল জানান, যুগল দত্ত বাহাগিলীর যমুনেশ্বরী নদী থেকে বালু তুলে আমার মহাজনের কাছে ১০০ টাকা ট্রলি দরে বিক্রি করে। সেখান থেকে আমরা বালু নিয়ে তারাগঞ্জ থানার ভেতর দিয়ে অর্পণ বাবুর পুকুরে এনে ফেলছি।
বালু ক্রয়কারী অর্পণ বাবু জানান, আমি ওই পুকুরটি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছিলাম। এখন যুগল দত্তের কাছ থেকে যমুনেশ্বরী নদীর ড্রেজিংয়ের বালু কিনে নিয়ে সেটি ভরাট করছি। এখন পর্যন্ত এক হাজার ২০০ ট্রলি বালু ফেলেছি। আরো ২০০ ট্রলি কন্ট্রাক্ট করা আছে। ৪৫০ টাকা করে প্রতি ট্রলি বালু আমি যুগলের কাছ থেকে কিনছি।
প্রকল্প এলাকায় স্যালো মিশিন দিয়ে অপর বালু উত্তোলনকারী কাসেম শাহ জানান, আমি মামুন শাহের কাছ থেকে ২৫৬ ফুট (৮২ মিটার) জায়গা ড্রেজিংয়ের জন্য সাব ঠিকাদারি নিয়ে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছি। আমি ড্রেজিং মেশিনও লাগিয়েছি।
প্রকল্প এলাকায় ক্ষতিপূরণের জন্য ভিড় করছিলেন সন্ন্যাসপাড়ার জোনাকুর পুত্র নাটুরাম। তিনি জানান, আমার তিন একর উঠতি পাট ও ভুট্টাক্ষেতে বালু ফেলেছে বালু ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা। কিন্তু প্রতিদিন এসে ঘুরে যাই। ক্ষতিপূরণ পাই না।
ক্ষতিগ্রস্ত আলেমা বেগম জানান, আমার পাট বাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। আমি বার বার সেখানে যাচ্ছি। কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণ পাচ্ছি না। সেখানে গেলেই বলা হচ্ছে চেয়ারম্যান আসুক তারপর দেখি। কিন্তু কিছুই পাচ্ছি না আমি।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার যুবলীগের সভাপতি ফণীভুষণ মজুমদার জানান, নদীর চর অপসারণ প্রকল্পের কাজের কারণে আমাদের পুরনো কালিমন্দির ভেঙে যেতে পারে। তাই মন্দির এলাকার কাজ বন্ধ রাখার জন্য পাউবোর কাছে লিখিত আবেদন করেছি। তিনি জানান, এ চর ড্রেজিং অপসারণের নামে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে টাকা হরিলুট করা হচ্ছে। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
এ বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় বাহাগিলী ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান শাহ দুলু। তিনি বরদি (বগুড়া-রংপুর-দিনাজপুর) প্রধান ক্যানেলের ব্রিজের পাশে শ্যালো বসিয়ে স্কুলের মাঠের ভেতর দিয়ে পাইপ নিয়ে গিয়ে নিজের দোলা জমি ভরাট করছেন। তিনিও প্রতি সিএফটি এক টাকা ৪০ পয়সা দরে বালু উত্তোলন করছেন।
এ ব্যাপারে বাহাগিলী ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান শাহ দুলু বলেন, আমি সাব-কন্টাক্টে কাজ করছি না। আমার কোনো মেশিন নেই। কন্টাক্টররা বালু উত্তোলন করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা না থাকার কারণে তারা আমার দোলা জমিতে বালু ফেলছে।
সাব-কন্ট্রাক্টর আওয়ামী লীগ নেতা এমদাদুল হক জানান, আমি ঠিকাদার নই। বাহাগিলী ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সাথে পার্টনারশিপে আমি চর ড্রেজিংয়ের কাজ করছি। যেহেতু বালু রাখার জায়গা নেই। সেহেতু আমরা চেয়ারম্যানের পুকুর ভরাট করছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানে উপস্থিত স্থানীয়রা জানান, চেয়ারম্যানরই ভালো। ওনি সিএফটি অনুযায়ী টাকাও নেবে প্রকল্পের কাছ থেকে। আবার বালু দিয়ে জমিও ভরাট করে নিচ্ছেন। তার দুই পাশেই লাভ।
সাব-কন্ট্রাক্টর দাবিদার যুবলীগ নেতা নজরুল ইসলাম জানান, আমি নাজমুলের কাছ থেকে সব কন্টাক্ট নিয়ে কাজ করছি। শ্যালো মেশিন দিয়েই চর ড্রেজিং করার কথা পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাদের বলেছে। আমরা করছি। শিডিউল অনুযায়ী কাজ করা হচ্ছে না কেন এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, কাগজ ধুয়ে পানি খান। আমরা যেভাবে করব। সেভাবেই কাগজ হবে। পারলে অভিযোগ করেন। আমাদের কেউ কিছুই করতে পারবে না।
প্রকল্প এলাকার তদারকি কর্মকর্তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও আনোয়ারুল ইসলাম সাজু প্রকল্পের বিষয়ে কোনো সন্তোষজনক উত্তর দেননি। সাইনবোর্ড না থাকা সম্পর্কে তিনি জানান, নিয়ম আছে, কিন্তু লাগানো হয়নি। ঠিকাদারকে বলা হয়েছিল, তারা দেয়নি। শিডিউল বহির্ভূতভাবে স্যালো মেশিন দিয়ে চর ড্রেজিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, নৌবাহিনীর ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড কাজটির ঠিকাদারি পেয়েছে। তারা নাজমুল হককে কাজটি দিয়েছে। নাজমুল হক সাব-ঠিকাদার দিয়ে কাজটি করছে। চারটি জায়গায় একযোগে কাজ চলার কারণে শ্যালো মেশিন দিয়েই ড্রেজিং করা হচ্ছে। বালু দিয়ে চেয়ারম্যানের জমি ভরাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করে তার জমি ভরাট করছে। ওনি তো জনপ্রতিনিধি। আমি ওনাকে বাধা দিই কিভাবে। বিক্রির বিষয়ে তিনি জানান, আমি বলে দিয়েছি আর যেন বালু বিক্রি না করে।
সরেজমিন একই চিত্র পাওয়া গেছে কিশোরগঞ্জের চারালকাটা নদীর নিতাই পানিয়াল পুকুর, তারাগঞ্জের যমুনেশ্বরীর জয়বায়লা রহিমাপুর এবং বদরগঞ্জের যমুনেশ্বরীর মাদাই খামার এলাকার চর ড্রেজিং প্রকল্পের।
সৈয়দপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুস শহীদ জানান, নৌবাহিনী কাজটি পেয়েছে। নৌবাহিনী কাকে দিয়ে করাচ্ছে সেটা তাদের ব্যাপার। চর ড্রেজিংয়ের বালু কেউ বিক্রি করতে কিংবা নিজের কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। যদি এ রকম কেউ করে থাকে তাহলে এখনই পুলিশকে বিষয়টি জানাচ্ছি। তিনি আরো জানান, প্রকল্পের বিষয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করা হবে।
নৌবাহিনীর সাব-ঠিকাদার নাজমুল হক জানান, নৌবাহিনীর থেকে কাজটি আমাকে দিয়েছে। কাজটি আমি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাজটি করতে গিয়ে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। এখন স্থানীয়রা কাজটি করছে। আমি কাজটি ছেড়ে দেবো। 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/215760