২৮ জুলাই ২০২৩, শুক্রবার, ৬:৩৮

ছয় মাসে ৮ মৃত্যু, ৭ জনই মোটরসাইকেল আরোহী

বেপরোয়া চলাচল ও ঝুঁকিপূর্ণ স্টিলের পাতের কারণে রাজধানীর মেয়র হানিফ উড়াল সেতুতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি-জুলাই পর্যন্ত) আটজনের মৃত্যু হয়েছে এই উড়াল সেতুতে। এঁদের মধ্যে সাতজনই মোটরসাইকেলচালক ও আরোহী ছিলেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন।

এই সময়ের মধ্যে রাজধানীর অন্যান্য উড়াল সেতুতে এত দুর্ঘটনা ঘটেনি।
হতাহতের পর এসব দুর্ঘটনার সংবাদ গণমাধ্যমে পাওয়া গেলেও ছোটখাটো অনেক দুর্ঘটনার তথ্য আড়ালে রয়ে গেছে। কালের কণ্ঠ’র সংবাদের আর্কাইভ ও রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সূত্রে দুর্ঘটনার তথ্য জানা গেছে।
সর্বশেষ গত ২৫ জুলাই রাতে গুলিস্তানে মেয়র হানিফ উড়াল সেতুতে ওঠার সময় মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মো. সাখাওয়াত হোসাইন নিলয় (৩৬) নামের এক যুবক নিহত হন।
এ ঘটনায় আহত হন তাঁর স্ত্রী রুপা।

১১.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়াল সেতু দিয়ে চানখাঁরপুল ও গুলিস্তান থেকে শনির আখড়া ও পোস্তগোলা পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। চার লেনের উড়াল সেতুতে উঠতে ছয়টি ও বের হতে সাতটি পথ রয়েছে। এত বেশি দুর্ঘটনার কারণ জানতে কথা হয় দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞ, দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য ও নিয়মিত যাতায়াতকারীদের সঙ্গে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হানিফ উড়াল সেতুতে দুর্ঘটনার অনেক কারণ রয়েছে। উড়াল সেতুতে উঠলেই প্রায় সব ধরনের গাড়ি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মোটরসাইকেলগুলো অতিরিক্ত গতিতে চালায় এবং বারবার লেন পরিবর্তন করে ওভারটেকিং করতে থাকে। আরেকটি হলো ফ্লাইওভারের কিছু জায়গায় বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা হয়। এতে যানবাহনের লেন দিয়ে চলাচল করছে যাত্রীরা।
নিরাপত্তার স্বার্থে এ কাজটি করা মোটেও উচিত নয়। দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, কিছু অংশে জোড়া বা এক্সপানশন জয়েন্টে ফাঁকা আছে, যেখানে সরু চাকার মোটরসাইকেল চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় চাকা স্লিপ করেন মোটরসাইকেলচালকরা দুর্ঘটনার শিকার হন। তাই দুর্ঘটনা রোধে জোড়ায় স্টিলের পাতে রাবার লাগিয়ে সুরক্ষিত করা জরুরি।’

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উড়াল সেতুতে দুর্ঘটনা হওয়ার কথা নয়। তার পরও বেপরোয়া গতি, লেন মেনে না চলা ও ওভারটেকিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে চালক ও পথচারীদের সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষ এগুলো নজরদারির মধ্যে রাখতে পারলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে আইন অমান্যকারীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’

হানিফ উড়াল সেতুতে ট্রাফিক পুলিশ বক্সে দায়িত্বরত একাধিক সার্জেন্ট জানান, উড়াল সেতুতে ওঠার পর গাড়িগুলো অতিরিক্ত গতিতে চালানো হয়। যে যেভাবে পারে লেন অমান্য করে চালাচ্ছে। ওপরের সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করার মতো ব্যবস্থা নেই। এ জন্য তারা সেভাবে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না। শুধু দুর্ঘটনা ঘটলে উড়াল সেতুর ওপরে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে ট্রাফিক পুলিশ।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামানের মতে, মেয়র হানিফ উড়াল সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। এর বড় কারণ বেপরোয়া গতি। আরেকটি কারণ হচ্ছে বকশীবাজারের দিকে উড়াল সেতু থেকে নেমে চার লেন হয়ে যায় দুই লেন। সেখানে বাসগুলো নামার সময় এমনভাবে থাকে, যাতে কোনো মোটরসাইকেল না নামতে পারে। কিন্তু মোটরসাইকেলচালকরাও সরু জায়গা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এভাবে বাসের ধাক্কায় কিংবা পিলারের ধাক্কায় অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে।

এআরআইয়ের পরিচালক বলেন, ‘হানিফ উড়াল সেতুতে ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে থাকার কথা, যেখানে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবে ও সতর্কতামূলক বার্তাগুলো দেবে। ওভার স্পিড করলে জরিমানা করতে পারে। এগুলো থাকলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এই উড়াল সেতুতে টোলপ্লাজা থাকায় অবকাঠামো ব্যবস্থাপনাও আধুনিক হওয়া জরুরি।’
ছয় মাসে আটজনের মৃত্যু

গত ৪ ফেব্রুয়ারি হানিফ উড়াল সেতুতে দ্রুতগামী বাসের ধাক্কায় রাকিব হাসান (৩২) নামের এক মোটরসাইকেল চালক নিহত হন। ১২ মার্চ গুলিস্তান এলাকায় কাভার্ড ভ্যানের চাপায় নিহত হন শাহাবউদ্দিন (৩৫) নামের এক যুবক। ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মো. এহসান হোসেন রুমি নামের এক কলেজ শিক্ষার্থী মারা যান। আহত হন মো. ফাতিন নামের আরেক কলেজ শিক্ষার্থী। ২১ এপ্রিল রাত ৯টার দিকে গুলিস্তানে উড়াল সেতুর ঢালে ট্রাকের ধাক্কায় বাইক আরোহী বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নওশীন আক্তার (২১) নিহত হন।

২৬ এপ্রিল দিবাগত রাতে টোলপ্লাজার পাশে বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল-চালক সাব্বির খান (২৫) নিহত হন। আহত হন তাঁর বন্ধু রাজীব (২৪)।

১৪ জুলাই সকালে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান মোটরসাইকেলচালক মতিউর রহমান (৪৫)। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী জাকিয়া খাতুন (৩১) গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। দুই দিন পর ১৬ জুলাই বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী পারভীন সুলতানা (৫৫) নামের এক আইনজীবী নিহত হন। এ ঘটনায় মোটরসাইকেলচালক শাখাওয়াত হোসেন হিমেল (৪০) গুরুতর আহত হন।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/07/28/1303052