২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১:৩১

সুনামগঞ্জে চালের ডিলারের দোকানে অভাবী মানুষের দীর্ঘ লাইন

অনেকেই খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন

কথা হয় বিশ্বম্বরপুর উপজেলার মাজইর গ্রামের ১৮ বছর বয়সী রিকশাচালক শরিফ উদ্দিনের সাথে। সব হারিয়ে সে এখন রিকশা চালক। করচার হাওরে ৫ কেদার জমি ছিল, ডুবে গেছে। রিকশা চালাও কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শরিফউদ্দিন কান্নার স্বরে বলেন ক’দিন থেকে শহরে রিকশা চালাচ্ছি। কি করব কোনো কাজ নেই। রিকশা না চালালে খাব কি, বাঁচবো কিভাবে। খোলা বাজারে চালের দোকানে শত মত মানুষের লাইন। খোলা বাজারের (ওএমএস) চালও কেনা দায়। কেউ পায় কেউ পায় না। অনেকেই খালি হাতে ফিরে যায়। শুনেছি সরকার আরো দেড় লাখ মানুষকে ভিজিএফ কার্ডের আওতায় ৩০ কেজি চাল ও ৫শ’ টাকা দিবে। কিন্তু আমরা পাব কিনা জানি না। এসব অনেক প্রশ্ন তার। এবারের অতিবৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে এবং বাঁধ ভেঙে শুধু শরিফ উদ্দিনের জমি ডুবেনি, এলাকার শত শত মানুষের জমি ডুবেছে।
সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। খোলা বাজারে চাল সরবরাহ অপ্রতুল। মানুষ সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়েও খোলা বাজারের ১৫ টাকা কেজির চাল কিনতে পারেনি। অনেকেই খালি হাতে বাড়ি ফিরেন। হতাশ খোলা বাজারের চাল কিনতে আসা গরিবরা। পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় যে দেড় লাখ কার্ডধারীদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তাও ক্ষতিগ্রস্তদের তুলনায় নিতান্তই কম। এ সকল নতুন কার্ডধারীদের সহায়তা এখনও বিতরণ করা হয়নি বলে বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা জানিয়েছেন। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা যাই দেয়া হচ্ছে, তা কেউ পাবে কেউ না এমন আক্ষেপের স্বরে কথা বলছেন অনেকেই।
জেলা কৃষি সম্প্রসার অধিদপ্তরের সূত্র মতে জানা গেছে জেলার ১১টি উপজেলায় প্রায় ৩ লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ জেলা প্রশাসকের ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা থেকে পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় দেড় লাখ পরিবারকে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাও ৩ মাস পাবেন তারা। দেড় লাখ কার্ডধারীদের ৫ হাজার ৭ শত মেট্রিক টন চাল এবং ৭ কোটি ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ৩ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে মাত্র দেড় লাখ কার্ড নিতান্তই কম। কেউ পাবে কেউ না। ফলে বঞ্চিতরা বঞ্চিতই থেকে যাবে। বঞ্চিতরা কোথায় যাবে এমন প্রশ্ন ওঠেছে সর্বত্র। খোলা বাজারের চাল সরবরাহও চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ ১৫ টাকা কেজির চাল পাচ্ছে না। জানা গেছে, প্রতিটি উপজেলায় তিনটি স্থানে তিনজন ডিলারের মাধ্যমে খোলা বাজারের চাল প্রতিদিন বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া পৌরসভার ৯টি ডিলারের মাধ্যমে ৯টি স্থানে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠইর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামছুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন আমাদের ৪টি ইউনিয়নের জন্য টুকের বাজারের একজন ডিলারের মাধ্যমে খোলা বাজারের ১৫ টাকা কেজির চাল বিক্রি করা হচ্ছে। ৫ কেজি চাল কিনতে অনেক দূর থেকে যেতে হয়। ৭৫ টাকার চাল কিনতে গিয়ে অনেকেরই খরচ হয় ৭৫ টাকারও বেশি। তাই গ্রামাঞ্চলের মানুষের জন্য এ চাল বিক্রি তেমন উপকারে আসছে না। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সবাই। চালের ও টাকার প্রয়োজন সবার। তাই মানুষের চাহিদার কথা বিবেচনা করে কমপক্ষে প্রতিটি ইউনিয়নে খোলা বাজারের ১৫ কেজির চাল বিক্রি করা আবশ্যক। নতুবা মানুষকে বাঁচানো কঠিন। চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম বলেন, সাড়া জেলায় নতুন দেড় লাখ কার্ড বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিজিএফ এর আওতায়। সরকারি চাল ও টাকা দেয়ার জন্য প্রতি কার্ডধারী ৩০ কেজি চালও ৫০০ টাকা পাবে। এটাও ক্ষতিগ্রস্তদের তুলনায় একেবারেই কম। তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নে মাত্র ১ হাজার কার্ডের জন্য ৩৮ মেট্রিক টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। এখনও বিতরণ করা হয়নি। সবেমাত্র বরাদ্দ এসেছে। দু’একদিনের মধ্যে বিতরণ শুরু হয়ে যাবে। এ নতুন বরাদ্দ অনেক ইউনিয়নেই সব মাত্র পৌঁছেছে বলে জানাগেছে। সুনামগঞ্জ শহরের ৯টি স্থানে খোলা বাজারের চাল বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিটি স্থানে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। দূর-দূরান্ত থেকে এসেও অনেকেই খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। চাল কিনতে পারছে না। তাছাড়া দূর থেকে এসে তাদের খরচ হয় বেশি। চাল নিতে আসা গরিবরা দাবি করেন সহজভাবে কেনার সুবিধার্থে প্রতিটি ইউনিয়নে চাল বিক্রি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এদিকে শহরের উকিলপাড়ার ডিলার বিধান বাবু জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে ২ টন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এখন থেকে ৪ শত জনকে ৫ কেজি করে চাল দেয়া যাবে। সদর থানার মোহনপুর ইউনিয়নের মোহনপুর গ্রামের ফরিদ মিয়া জানান আমাদের এলাকার জন্য ডিলার দেয়া হয়েছে টুকের বাজারে। টুকের বাজার আমাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। খোলা বাজারের এ চাল কিনতে গিয়ে অনেক খরচ হয়ে যায়। একদিন গিয়ে ফিরত এসেছি চাল কিনতে পারিনি। মানুষের অনেক লম্বা লাইন থাকে প্রতিদিন। গরিব মানুষের সুবিধার্থে প্রতিটি ইউনিয়নে খোলা বাজারের চাল বিক্রি চালু করা দারকার। নতুবা গরিবেরা চাল কিনতে পারবে না। গরিবরা চালের খাদ্যের অভাবে অনাহারে দিন কাটাতে হবে। অনাহারে থেকে মানুষ মারা যাবে। এখন এলাকায় কাজকর্মও নাই। সবাই বেকার। গ্রামে গ্রামে কি করুণ অবস্থা, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবার জেলায় অতিবৃষ্টি,পাহাড়ি ঢল আগাম বন্যা ও বাঁধ ভেঙে সারা জেলায় ২ লাখ ৯৯ হাজার ৮২৪ জন কৃষক ফসল হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা ফসল হারিয়েছেন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা হচ্ছে ধর্শপাশা উপজেলা। এ উপজেলায় ৩১ হাজার ৮ শত হেক্টর আবাদকৃত ভূমির মধ্যে ২৬ হাজার ২৫০ হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ উপজেলায় ধনী-গরিব সকল সমান হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা হয়েছে ৪৮ হাজার ৮৭৬ জন। অথচ এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের জন্য ১৯ হাজার ৬০০ জনকে ভিজিএফ কার্ড ও ৭ শত ৪৪ মেট্রিক টন চাল ও ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্ব দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তুলনায় এ বরাদ্দ নিতান্তই কম বলেছেন এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা। এটি একটি উপজেলার চিত্র। সকল উপজেলার মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সবাই এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। ১৫ টাকা ও ১০ টাকা কেজির চাল কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে অনেকেই। ফসল হারিয়ে সবাই নিঃস্ব। হাতে নেই টাকা, ঘরে নেই চাল কিংবা ধান। তাই ভিজিএফ সহায়তা আরো বাড়ানো দরকার। নতুবা এ অঞ্চলের মানুষকে না খেয়ে থাকতে হবে। দেখা দিবে ঘরে ঘরে মহা বিপর্যয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগের সূত্র মতে, সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার হাওরে এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছিল। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ১২ লাখ মেট্রিক টন ধান। প্রায় সব হাওরই ডুবে গেছে। আবাদি জমির ৯০ ভাগ ফসলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/77125/